একাত্তরে যুদ্ধে হেরেছিল পাকিস্তান; তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু জিতেছিল কে? বাংলাদেশ না ভারত? চূড়ান্ত লড়াই দুই পক্ষ একসঙ্গে করলেও প্রতিরোধ যুদ্ধটি শুরু করেছিল বাংলাদেশ, ওই বছরের ২৬ মার্চ।
সেই জয়ের একক কৃতিত্ব দাবি করে ১৬ ডিসেম্বর সোমবার সোশাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
বাংলাদেশে যখন বিজয় দিবস উদযাপন হচ্ছে, তখন মোদীর সেই পোস্টে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বাংলাদেশ থেকে।
বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক যখন নাজুক, তখন মোদী কেন এই পোস্ট দিলেন, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে কাঙাল হয়ে থাকা বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিল তখন, যখন পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে গণহত্যা শুরু করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের কোটি বাঙালি যুদ্ধের সময় আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এক পর্যায়ে ডিসেম্বরে ভারতে নামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে, গঠিত হয় যৌথবাহিনী। এই যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালির পাশাপাশি ১০ হাজারের বেশি ভারতীয় সৈন্যও জীবন দেয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী।
১৬ ডিসেম্বর দিনটি বাংলাদেশ পালন করে বিজয় দিবস হিসাবে; বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার দিনটি ভারতের সেনাবাহিনীও পালন করে থাকে নিজস্ব বলয়ে।
কিন্তু এবার মোদী সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে লিখেছেন- “আজ এই বিজয় দিবসে আমরা সম্মান জানাই সেইসব সাহসী ও আত্মোৎসর্গকারী বীর সৈনিকদের, যারা ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে ভূমিকা রেখেছে। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মদান এবং অটল সংকল্প রক্ষা করেছে আমাদের জাতিকে এবং আমাদের জন্য এনে দিয়েছে গৌরব। এই দিনটি তাদের অসাধারণ বীরত্ব এবং অদম্য চেতনার জন্য মহান। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে, গেঁথে থাকবে জাতীয় ইতিহাসে।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই পোস্ট দেখার পর সকালেই প্রতিক্রিয়া জানান শেখ হাসিনা সরকার হটানোর আন্দোলনে নেতৃত্বদাতা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু মোদী দাবি করেছে, এটি শুধু ভারতের যুদ্ধ এবং তাদের অর্জন। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই উপেক্ষিত।”
এই ধরনের বক্তব্যকে বাংলাদেশের জন্য হুমকি হিসাবে দেখার কথা জানিয়ে পাল্টা হুঁশিয়ারিও দেন হাসনাত।
তিনি লেখেন, “যখন এই স্বাধীনতাকে ভারত নিজেদের অর্জন হিসেবে দাবি করে, তখন আমি একে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখি। ভারতের এই হুমকির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।”
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও প্রতিবাদ জানিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এই বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও মোদীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোকে বলেন, “৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রামকে ভিন্নভাবে দেখা উচিৎ নয়। একটি জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সঙ্গে দেখা উচিৎ।”
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেনও প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বন্ধুসুলভ মনোভাবের প্রকাশ নয়। কর্তৃত্ববাদী চিন্তা থেকে এ ধরনের বক্তব্য এসেছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ভারত যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে না, তা মোদীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হলো।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ফেইসবুকে লিখেছেন, “বাংলাদেশের বিজয় দিবস নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয় দিবস। এই বিজয় আমাদের দেশের গণমানুষের।”
তবে এই বিজয়ে ভারতের ভূমিকার কথা স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, “ভারতের মিত্র বাহিনী এই যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল, যা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পাশাপাশি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ যারা সহযোগিতা করেছিল, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।”
মোদীকে তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রিন্স। পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও ভারত সরকারের কাছে এর প্রতিবাদ জানাতে বলেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারানোর একক কৃতিত্ব নিতে ভারতীয় পরিমণ্ডলকে বিভিন্ন সময় সক্রিয় দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর পাশাপাশি ভারতের কংগ্রেস নেতা প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও সোমবার সোমবার বক্তব্যে ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত বিজয় অর্জন করে বলে মন্তব্য করেন।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালে মোদী শুভেচ্ছা জানিয়ে সোশাল মিডিয়া পোস্টে লিখেছিলেন। তখন তিনি দুই দেশের বিজয়ের কথা বললেও এবার বাংলাদেশের নাম একেবারে এড়িয়ে গেছেন।
মোদীর এবারের বক্তব্য নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, “নরেন্দ্র মোদীর এই মন্তব্য একটি প্রতিষ্ঠিত বয়ান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এটার পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ মোদী সরকার সব ক্ষেত্রে ভারতের একক কৃতিত্ব দেখাতে পছন্দ করে।”
গত দেড় দশক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলোর নেতারা। শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ায় ক্ষুব্ধ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের পাশাপাশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও।
গত ৫ আগস্ট থেকেই ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপড়েন চলছিল। হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তা উত্তেজনার দিকেও গড়ায়।
এই পরিস্থিতিতে গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রি। তাতে দুই দেশেই উত্তেজনা কিছুটা কমার লক্ষ দেখা গেলেও মোদীর পোস্টের পর নতুন বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি হলো।