বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে ৫৪টি; জাতীয় ঐকমত্য গড়তে তার অর্ধেকের কম দলকে নিয়ে বৈঠক করল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই বৈঠকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু বললেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। জানালেন, তাদের এখনকার উদ্দেশ্য ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এই বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিল না। ডাক পায়নি তাদের জোট ১৪ দলের কোনো দল। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি আওয়ামী লীগ আমলের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও।
ফলে আওয়ামী লীগ আমলে যেভাবে একতরফা নির্বাচন হতো, কিছুটা তেমনই একটি বৈঠক হয়েছে শনিবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে, ইউনূস নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ডাকে।
তবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এই বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে দ্বিমত উঠল স্পষ্ট হয়ে। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপিসহ অধিকাংশ দল আগে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী চাইছে, আগে হোক স্থানীয় নির্বাচন।
আবার জুলাই আন্দোলনকারীদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে বৈঠকে গিয়ে আগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে এসেছে।
গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করে। এরপর সেই কমিশনের প্রধানদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’, যার নেতৃত্ব ইউনূস নিজেই রয়েছেন।
শনিবার ঐকমত্য কমিশন প্রথম বৈঠকে বসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। চার ঘণ্টার এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতসহ ২৬টি রাজনৈতিক দলের শতাধিক নেতা অংশ নেন বলে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও এই বৈঠকে ডাক পায়।

বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আজ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো।
কোন নির্বাচন আগে?
ন্যূনতম সংস্কার হলে সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে, আর সম্পূর্ণ সংস্কার হলে তা হবে আগামী বছরের জুন মাসে। এটা ইউনূস অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন।
কিন্তু সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলে সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক তোলে জামায়াত, যদিও তাদের নিবন্ধনই নেই।
সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার আগ্রহ সরকারেরও রয়েছে এবং নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় থাকা ছাত্ররাও তেমনটা চাইছে বলে খবর আসছে সংবাদ মাধ্যমে।
তবে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল শনিবারের বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের দাবিই জানিয়ে এসেছে, যে খবর দিয়েছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো।
অভ্যুত্থানের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বেড়েই চলছে। নির্বাচন প্রশ্নে তা আরও বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে।
শনিবার বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের প্রশ্নে সাফ জানিয়ে দেন, “এটা নিয়ে আগেও বলেছি, আমাদের কথা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হতে হবে। তারপর স্থানীয় নির্বাচন।”
বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে এক সময় জোটে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থও আগে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেন। তিনি বলেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ধারণা, নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় থাকা ছাত্ররা আগে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ভিত গড়ে তারপর জাতীয় নির্বাচনে যেতে চায়। কারণ স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী চেয়ারম্যান-মেয়রদের একটি প্রভাব থাকে জাতীয় নির্বাচনে।

কিন্তু জামায়াত কেন সেই পথে হাঁটছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল দেখা দিয়েছে গত বৃহস্পতিবার তারা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে স্থানীয় নির্বাচন আগের করার পক্ষে মত জানিয়ে আসার পর।
শনিবারের বৈঠক শেষে সাংবাদিকরা সেই প্রশ্ন রেখেছিলেন জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের কাছে। তিনি কৌশলী উত্তরে বলেন, “আমরা বলেছি সংস্কার প্রয়োজন। তারপর যথা শিগগিরই সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।”
আগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ?
অভ্যুত্থানের পরপরই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আওয়াজ তুলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কিন্তু বিএনপি তার বিপরীত অবস্থান নিলে তা আর বেশি দূর গড়ায়নি। এরপর নানা প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধীদের ফারাক ক্রমেই বাড়ছে। নতুন দল গঠন নিয়েও বিএনপি নেতাদের সন্দেহ রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন চাইছে। তাদের যুক্তি, নইলে দেশের রাজনীতি আবার পুরনো ধারায়ই চলবে।
শনিবার আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্র দলগুলোর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং দলটির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানায়।
বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “সরকার যেন উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে এবং পরবর্তীতে কোনো প্রক্রিয়ায় যেন রাজনৈতিকভাবে সে ফাংশনাল না হতে পারে, সেই প্রস্তাব দিয়েছি।”
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাদের ‘রাজনৈতিকভাবে ডিসফাংশনাল’ করা যায় বলে মত দেন তিনি।
“আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রথম ধাপ হিসেবে আমরা প্রস্তাব করেছি আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়ার। যাতে নিবন্ধন বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে ডিসফাংশনাল করা যায়।”
এক্ষেত্রে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও একমত হয়েছে দাবি করে হাসনাত বলেন, “এই প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলকে আমরা ঐকমত্যে পেয়েছি।”
তবে এবিষয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষ্য সংবাদমাধ্যমে আসেনি। বিএনপি আগে থেকে বলে আসছে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতি তারা নয়।
সরকার কী বলছে?
বৈঠকে স্থানীয় নির্বাচন আগে না কি সংসদ নির্বাচন আগে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি হবে না, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শেষে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য একটি সনদ তৈরি হয়। যেটা হবে জুলাই সনদ বা জুলাই চার্টার।
তিনি বলেন, “সংলাপের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে, প্রস্তাবের পেছনে এতগুলো দল একমত। পরে সনদ যখন হয়ে যাবে, তখন সেটা প্রকাশ করা হবে। যাতে মানুষ জানতে পারে কোন রাজনৈতিক দল কতগুলো প্রস্তাবে একমত হয়েছে। এই সনদকে আমরা জাদুঘরে সংরক্ষণ করব।”
তিনি ‘গভীর সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন’ বলে বাসসের প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সংস্কারের বিষয়ে একমত না হলে আমাদের মুক্তি নেই। সারাদেশের মানুষ বলবে-তোমরা সনদে সই করলে না, সংস্কার করলে না-আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেলে।”
বৈঠক শেষে কমিশনের সদস্য আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের য় বলেন, “সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে আমরা আলাদা আলাদাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলবো। আমরা জোটগতভাবে কথা বলব। এক পর্যায়ে হয়তো আবার সকলকে একত্রিত করে ফিরে আসব।”
সংস্কার কবে শেষ হবে- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এই কমিশনেরই মেয়াদ দেয়া হয়েছে ছয় মাস। সেক্ষেত্রে লক্ষ্য হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে চাই।
“আমরা আশা করছি যে ছয় মাসের চেয়েও কম সময়ে সম্ভব হয়। যদি তাই হয় তাহলে বুঝতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ আছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও মনে করে যত দ্রুততর সময়ে সম্ভব সেটা করার। কিন্তু এটা হয়ত অকস্মাৎ হবে না।”