আগামী ডিসেম্বরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সেটি নিশ্চিত করেছে অন্তবর্তী সরকার। মার্চে পবিত্র রমজান শুরু হয়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর কালবৈশাখী ও বর্ষা মৌসুম শুরু হবে। সাধারণত বর্ষায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় না। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচনের উপযুক্ত সময় মনে করছে অন্তবর্তী সরকার।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে সেটি বারবার জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
সোমবার বাংলাদেশ সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সমতা, প্রস্তুতি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কমিশনার আদজা লাবিব রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভোট সম্ভবত এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।”
এর আগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটের এক অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব—সম্ভবত এই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে।’
অন্তবর্তী সরকার যে ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য কাজ করছে বিএনপিকে তা আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করে।
পরে সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন “অন্তবর্তীকালীন সরকার ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করছে বলে তাদের আশ্বস্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।”
“আশা করছি এবং জনগণের যেটা প্রত্যাশা আছে যে, অতি দ্রুত নির্বাচন এবং একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা), যার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হবে।” বলেন ফখরুল।
নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি যদি খুব ভুল না করে থাকি তাহলে অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণা, ডিসেম্বরে নির্বাচন এবং জানুয়ারির মধ্যে নতুন সরকার গঠন হতে পারে—এমন সংকেত পাচ্ছি।”
ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তখন সেই সময়কে ধরে প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।
গত ৪ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, “কমিশন এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনৈতিক দল অনেক কথা বলবে, কমিশন রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে যেতে পারবে না। সরকারপ্রধান যেখানে একটা টাইমফ্রেম ঘোষণা করেছেন, হয় ডিসেম্বরে নয়তো ২০২৬ সালের শুরুর দিকে। আমরা ডিসেম্বরকে ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমাদের সব প্রস্তুতি আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে৷ আমাদের মাথায় এখন জাতীয় নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়৷ ভোটার তালিকা থেকে থেকে সব কাজ আমাদের ঠিক মতো চলছে৷”
আরেক নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘‘আসলে সব কিছু ভালোর দিকেই যাচ্ছে৷ সরকারও প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আমরাও সেটা ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ ডিসেম্বরে নির্বাচন, অক্টোবরে তফসিল সেই টার্গেট নিয়েই আমরা কাজ করছি৷ আর সেটার জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি আমরা জুলাই মাসের মধ্যে শেষ করার আশা করছি৷’’
ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছে বিএনপিসহ একাধিক দল। নির্বাচন কমিশন যাতে ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে পারে সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা করতে সরকারের কাছে আহবান জানিয়েছে বিভিন্ন দল।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন৷ তারা স্বাধীন সিদ্ধান্তই নেবে৷ তারপরও নির্বাচন পরিচালনায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সযোগিতা তাদের লাগে৷ নির্বাচন কমিশন যেহেতু বলছে তারা ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আমার মনে হয় সরকারের সঙ্গে কথা বলেই তারা এগোচ্ছে৷ সরকার তাদের হয়তো গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে৷ ”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন , ‘‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের যে বৈঠক হয়েছে তাতে আমরাও নিশ্চিত হয়েছি যে তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এখন এই প্রস্তুতিতে সরকারের দিক থেকে কিছু সহায়তা প্রয়োজন৷ সবচেয়ে বড় কথা সরকারের দিক থেকে নির্বাচন কমিশনকে এখন ক্লিয়ার সিগন্যাল দিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচনের জন্য সব ধরনের সহায়তা স্পষ্ট করা দরকার৷’’
অন্তবর্তী সরকার, বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশন যখন ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন উল্টো কথা বলছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)।
মঙ্গলবার সকালে ঢাকার রায়েরবাজারে অভ্যুত্থানের সময় নিহত ছাত্র–জনতার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, “শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো মানুষ, কোনো রাজনৈতিক দল ভুল করেও যেন নির্বাচনের কথা না বলে। যতদিন না আমরা খুনি হাসিনাকে ওই ফাঁসির মঞ্চে না দেখছি এই বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।”
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে। জাতীয় নির্বাচনে গণপরিষদ নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”
“যত দিন না পর্যন্ত খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে দেখছি, তত দিন যেন কেউ ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলেন”- সারজিস আলমের এই হুমকিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে “সিঁদুরে মেঘ” দেখছেন বিএনপিসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের বলেন, “কিছু কিছু লোক নির্বাচন প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়ার জন্য, নির্বাচন না করার জন্য একটা অজুহাত তৈরির পাঁয়তারা করছে। এতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত কাজ করছে। বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল হয়ে যায়, অনেকেরই ক্ষতি হবে। নির্বাচন যারা পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে, তাদের ক্ষতি হবে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া পেছানোর জন্য কোনো অজুহাত তৈরি করা যাবে না।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, “আমি মনে করি, দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। তবে এটি কত দ্রুততম সময়ের মধ্যে হবে, তা নির্ভর করবে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। প্রয়োজনীয় আইনকানুন, বিধিবিধান সংস্কার করে সেসব কার্যকর করতে দলগুলো কত দ্রুত সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে আসবে, তার ওপর।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বিএনপি নির্বাচন চায় ডিসেম্বরের মধ্যে। জামায়াত তো চায় বলে মনে হয় না। আবার ছাত্রদের যে নতুন রাজনৈতিক দল হয়েছে, তারা তো নির্বাচন পিছাতে চায়। সব মিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি আমি এখানো দেখছি।”
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট থেকে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ শুরু করে৷ এরপর সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন এই দুই ইস্যুতে সরকারের উপর প্রত্যাশা বাড়তে থাকে৷ এরইমধ্যে সরকারের সাত মাস পার হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচনের দাবি প্রবল হচ্ছে৷ সরকারের ছয়টি সংস্কার কমিশন এরইমধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিয়েছে৷