অনেক দিন এদিক-সেদিক করে শেষমেশ ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তাতে বিএনপি সন্তষ্ট হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী নিমরাজি হলেও বেঁকে বসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেওয়াদের গড়া দল এনসিপির নেতারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না বলে আওয়াজ তুলেছেন।
তাতে সমর্থন দিয়েছেন ফরহাদ মজহার, জুলাই অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিদের অনেকেই যার ভাবশিষ্য। নির্বাচনের পরিবেশ নেই- বলার পাশাপাশি নিজের বক্তব্যের সপক্ষে সেনাবাহিনীকেও জড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
ফলে ঘোষিত সময় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া নিয়ে ফের সংশয় দানা বাঁধছে; যদিও দেশকে অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে বের করে আনতে দ্রুত নির্বাচিত সরকার দেখতে চাইছে ব্যবসায়ীরা।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল বলে অভিযোগ দেশে-বিদেশে সবখানে।
গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ইউনূস নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কথা বলছিলেন না। সংস্কারে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি বলছিলেন, নির্বাচন হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে। তবে কখন হবে, তা নির্ভর করছে জনগণের চাওয়ার ওপর।
তা দেখে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জোর দাবি তোলে। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে ইউনূস জানান, সব প্রস্তুতি সারা গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।
এর মধ্যে দেশে বিনিয়োগে খরা দেখে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও বলেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার না এলে অর্থনৈতিক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতিতে গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।
বিএনপি তাতে সাধুবাদ জানালেও তাদের সাবেক মিত্র জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ এখনও সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি, তবে তারা ভোটের জন্য প্রস্তুত।
নির্বাচনের সময় নিয়ে অনাপত্তির কথা জানিয়ে তখন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার দৃশ্যমান করা এবং সংস্কার বাস্তবায়ন করা এই সরকারের দায়িত্ব।

কিন্তু মঙ্গলবার ইউনূস যখন মালয়েশিয়ায় বসে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনে সরকার প্রস্তুত রয়েছে বলে জানালেন, তখন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিপরীত সুর শোনা গেল এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কথায়।
দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জাতীয় যুব শক্তি আয়োজিত সম্মেলনে বলেন, “ইলেকশনের ডেট ঘোষণা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।
“যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল সংস্কারের জন্য, একটি নতুন সংবিধানের জন্য, তাহলে কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে।”
নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “একই সংস্কৃতির ডামাডোলে, একই ফ্যাসিবাদী সংবিধানে, একই সিস্টেমের মধ্যদিয়ে নির্বাচনে যাওয়া হচ্ছে। তাহলে এতগুলো মানুষ শহীদ হওয়ার প্রয়োজন কী ছিল? এতগুলো মানুষ আহত হওয়ার প্রয়োজন কী ছিল?”
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এই অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচন, ভোটাধিকারের জন্য আমাদের লড়াই ছিল। কিন্তু আমরা এও বলেছি, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যেতে হবে।”
জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের দাবি তুলে তিনি বলেন, “গত এক বছর ছাড় দিয়েছি। জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দিয়েছি। জুলাই সনদে কোনো ছাড় হবে না। এক পার্সেন্ট ছাড়ও জুলাই সনদে দেয়া হবে না।”
নাহিদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “সমীকরণ এখনো শেষ হয়ে যায় নাই। ফলে যারা এখনই সমীকরণ মিলিয়ে ফেলছে, তারা ভুল পথে হাঁটছে। গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি এখনো রাজপথে আছে।”
এই দিনই ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় ফরহাদ মজহার বলেন, “আমরা নির্বাচনবিরোধী। কারণ নির্বাচন করে লুটেরা মাফিয়া-শ্রেণিকে, যারা বিভিন্নভাবে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে, তাদেরকে আপনারা আবার বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসাতে চান। আপনারা আরেক সংসদ বানাতে চান, এখানে লুটেরা মাফিয়া শ্রেণি থাকবে। এটা আমরা প্রত্যাখ্যান করি।”
বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের কোনো পরিস্থিতি নেই দাবি করে তিনি বলেন, “নির্বাচন করা মানে সেনাবাহিনীকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া।
“আমরা চর্তুদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। মিয়ানমার… আরাকান থেকে এই রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে, তারা বাংলাদেশে বসে আছে টাইম বোমার ওপরে। আপনি সেনাবাহিনীকে অতিক্রম করে করিডোরের কথা বলেন। করিডোর দিতে চান কী জন্য? সেনাপ্রধানের সাথে কথা বলেছেন কি? আপনি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দিতে চান, এটা তো নিরাপত্তার বিষয়, সামরিক বাহিনীর বিষয়। আপনি কি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন?”
বাংলাদেশের সামনে অনেক ‘বিপদ চিহ্ন’ দেখছেন জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, “যদি বাংলাদেশে আমরা সকলে একমত হয়ে নির্বাচন না করি, তাহলে এটা বিপদের দিকে আমরা বাংলাদেশকে ঠেলে দেব।”
“আমরা কী চাই? আপনি পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করুন। কিন্তু সংবিধান বাদ দিন, নির্বাচন বাদ দিন। আসেন, আমরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রক্রিয়ায় ঢুকি,” ইউনূসের উদ্দেশে বলেন তিনি।