মাহফুজের পোস্টের পর আবার কী হচ্ছে?

বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয় যমুনার সামনে  বিক্ষোভ।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হয় যমুনার সামনে বিক্ষোভ।

জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলমের এক ফেইসবুক পোস্টের পর আবার দেখা দিয়েছে উত্তেজনা।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা-কর্মীরা, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্যারিস থেকে সেই কর্মসূচিতে সমর্থন দিচ্ছেন ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য, যিনি বছরের শুরুতে বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলার ইন্ধন দিয়েছিলেন।

অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো নয় মাস পর দ্বিধা বিভক্ত বলে মাহফুজের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ফের একতার আওয়াজ তুলেছেন হাসনাত। আবার মাহফুজের মতোই উপদেষ্টার পদে থাকা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলমসহ অভ্যুত্থানের অন্য তরুণ নেতারা।

বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করে ইউনূসের বাড়ির সামনে শুরু হওয়া অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে সবার কৌতূহল দেখা দিয়েছে। একে ‘নাটক’ও বলছেন কেউ কেউ।

যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, সেই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন নাহিদ, আসিফ, হাসনাত, সারজিসরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে পেছন থেকে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক শিক্ষার্থী মাহফুজ।

এরপর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে তাকে অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেন।

অন্তর্বর্তী সরকারে নাহিদ, আসিফ ও মাহফুজ উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। পরে নাহিদ উপদেষ্টার পদ ছেড়ে তাদের গড়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক হন। হাসনাত ও সারজিস তার সঙ্গে যোগ দিয়ে দলটির মুখ্য সংগঠকের পদ নেন।

যা লিখেছেন মাহফুজ

অভ্যুত্থানের এই তরুণ নেতারা পর গত নয় মাসে নানা বিকর্কিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার মধ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘কৈফিয়ত’ শিরোনামের এক ফেইসবুক পোস্টে মাহফুজ বলেন, অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ায় তাদের লক্ষ্য অর্জন দূরে সরে যাচ্ছে।

তিনি লেখেন, “ছাত্রদের কয়েকটি দল হয়ে যাওয়াতে তারা এখন বিভক্ত, তদুপরি অন্য রাজনৈতিক দলের মতোই তারা ট্রিটেড হচ্ছেন।

“এজন্য নাগরিক কমিটিই ছিল দীর্ঘমেয়াদে অভ্যুত্থানের ফোর্স হিসাবে টেকসই। যাইহোক! এদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্ম দেশব্যাপী ছাত্রদের গুছিয়ে উঠতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অভুত্থানের ছাত্র- জনতা বিভক্ত ও দ্বিধান্বিত।”

ডান-বাম-মধ্যপন্থি সব দলকে দোষারোপের পাশাপাশি মাহফুজ বলেছেন, “সবচেয়ে ডেডিকেটেড ছাত্রকর্মীরা ক্রেডিট, দলবাজি আর কোরামবাজির খপ্পরে পড়েছেন। আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ডিমোরালাইজড হয়েছে সমগ্র ছাত্র- জনতা।”

তিনি ও আসিফ উপদেষ্টার পদে থাকলেও সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সম্মিলিত যোগসাজশে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন বলে মাহফুজের দাবি।

তিনি লিখেছেন, “রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই৷ কিন্তু, ঠিকই প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশে তারা স্টেইক নিয়ে বসে আছেন। এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিদলীয় বৃত্তে ফিরতে এবং ছাত্রদের মাইনাস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

“প্রায় তিন ডজন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ছাত্র মাত্র দু’জন। ছাত্র প্রতিনিধিদেরকেও এস্টাবলিশমেন্ট রাষ্ট্রপতি অপসারণের (দাবির) ঘটনার পর থেকে কোনঠাসা করে রেখেছে।।”

এভাবে ‘জোড়াতালি’ দিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর নয় মন্তব্য করে মাহফুজ লিখেছেন, “এর সমাধান রাষ্ট্র ও এস্টাবলিশমেন্টে ছাত্রদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আঘাত করা। এগুলো করার পূর্বশর্ত হল, ছাত্রদের মধ্যে সততা, আদর্শ, নিষ্ঠা ও ঐক্য ফিরিয়ে আনা। পুরাতন বন্দোবস্তের সৈনিকদের অকার্যকর করে তোলা।”

এরপর যা ঘটছে

মাহফুজের এই পোস্ট নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হলে কয়েক ঘণ্টা পর হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেইসবুক পোস্টে বলেন, “আওয়ামী লীগের বিচার প্রশ্নে যারা মাহফুজ আলমের উপর ক্ষোভ ঝাড়ছেন, তারা হয় অন্যের খেলার গুটি হচ্ছেন, নাহলে তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।

“মাহফুজ, আসিফ, নাহিদরা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই লীগের বিচার ও নিষিদ্ধ ঘোষণা চায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে কারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করুন।”

যমুনার সামনে একদল নেতাকর্মী।

এরপর রাত ১০টার দিকে ঢাকার মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে হাসনাতের নেতৃত্বে জড়ো হয় একদল নেতা-কর্মী। তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে।

অভ্যুত্থানের পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সায় না পাওয়ায় সে পথে আর এগোয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে গঠিত এনসিপি সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করলেও তারপর আর বড় কোনো কর্মসূচি পালন করেনি।

বৃহস্পতিবার রাতে হাসনাতরা যমুনায় অবস্থান নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে মাহফুজ আরেক ফেইসবুক পোস্টে বলেন, “দল হিসাবে লীগের বিচারের প্রভিশন যুক্ত করা হবে। ফ্যাসিস্ট লীগের বিচার হবেই। বিচার কাজ ত্বরান্বিত করতে ট্রাইবুনাল-২ গঠিত হচ্ছে।”

এর পরপরই হাসনাত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে পরপর কয়েকটি পোস্ট দেন।

তখন উপদেষ্টার পদে থাকা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক পোস্টে লেখেন, “নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই প্রসেস করে সব ফরমালিটি শেষ করে এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে আছে।”

তার এই পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় নাহিদ ইসলাম আবার ফেইসবুকে লেখেন, “যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নিষিদ্ধ করার প্রহসন মেনে নেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিস্ট সংগঠন ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করতে হবে। আইসিটি আইনে দল হিসেবে বিচার করার বিধান যুক্ত করতে হবে।”

তিনি আরেক পোস্টে লেখেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি ফ্যাসিস্ট ও খুনি আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে টালবাহানা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারের রাষ্ট্রপতিকে চোখের সামনে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। আজ রাতেই ফয়সালা হবে আওয়ামী লীগের বিষয়ে।”

এই দাবিতে সবাইকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়ে নাহিদ বলেন, “আওয়ামী লীগের বিচার, নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না আসা পর্যন্ত আমরা রাজপথ থেকে উঠব না।

“সবাই চলে আসুন। জুলাইয়ে সকল শক্তি, সকল শহীদ পরিবার ও আহতদের আহ্বান জানাই রাজপথে নেমে আসুন। বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।”

এরপর সারজিস আলম এক ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “হাসনাতের সাথে যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিন। নয় মাসে সোজা আঙ্গুলে কাজ হয়নি। এখন সময় আঙ্গুল বাঁকা করার।”

এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে প্রবাসে থেকে কাজ করে যাওয়া পিনাকী ভট্টাচার্য ফেইসবুকে পোস্টে দিয়ে সবাইকে যমুনায় যাওয়ার আহ্বান জানান।

“সবাই যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে চলে আসুন৷ আজ রাতেই আওয়ামী লীগ ব্যানের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে৷ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ ব্যানের ধারবাহিক নাটক মেনে নেওয়া হবে না।”

এসময় আসিফ আরেক পোস্টে লেখেন, “যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কিছুদিন আগেই হয়েছে। এটা আন্দোলন দমনের কোনো প্রক্রিয়া নয়। বরং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পথেই আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।”

এরমধ্যে এনসিপির পক্ষ থেকেও আহ্বান জানিয়ে ফেইসবুকে লেখা হয়, “গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আছি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে।

দল-মত নির্বিশেষে সবাই যোগ দিন যমুনার সামনে।”

মধ্যরাতে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ও সদস্য সচিব আখতার হোসেনেরও সেখানে উপস্থিত হওয়ার ঘোষণা দেন হাসনাত।

তিনি ফেইসবুকে লেখেন- “জুলাইয়ের সব শক্তি আবার ঐক্যবদ্ধ।”

এদিকে তাদের এই কর্মসূচির পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্য চলছে ফেইসবুকে।

একজন লিখেছেন, “আজ শিবির ছাড়া কি হাস্নাত-নাহিদ- সারজিসদের পাশে কেউ কি আছে?”

আরেকজন লিখেছেন, “প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে যে-নাটকটি চলছে, সেটি শেক্সপিয়ারের নাটকের চেয়েও নাটকীয়। সফোকলের নাটকেও এমন উত্তেজনা নেই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads