বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল ঢাকার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের একটি ভবনে, তখন জমল উৎসুক মানুষের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে উদ্ধার কাজ চালাতেও বেগ পেতে হচ্ছিল উদ্ধারকর্মীদের। বারবার মাইকিং করে সবাইকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানালেও তাতে কাজ হচ্ছিল না। এই ভিড়ের মধ্যে একদল ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভিডিও করতে, সাংবাদিকরাও সক্রিয় হয়ে ওঠেন ক্যামেরা নিয়ে।
এরপর হাসপাতালে একই অবস্থা। প্রথমে সাংবাদিকদের ভিড়, তারপর সদলবলে রাজনীতিকদের পরিদর্শন। সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল এক অবস্থা! চিকিৎসকরা বার বার বলছিলেন তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটার কথা। কিন্তু তাতে কান দেবে কে?
সোমবার এই বড় দুর্যোগের পর সোশাল মিডিয়ায় কড়া সমালোচনা চলছে এনিয়ে।
এই বিমান দুর্ঘটনায় বৈমানিকসহ ২০ জনের মৃত্যুর খবর সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের ১৭ জনই শিশু। সাতজনের দেহ এতটাই পুড়েছে যে চেনার উপায় নেই। আহতের সংখ্যা শতাধিক। তাদের বেশিরভাগই রয়েছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তাদের অনেকের অবস্থাও গুরুতর বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. নাসিরউদ্দিন।
বাংলাদেশে যে কোনো দুর্যোগে সাধারণ মানুষ ছুটে যায় সহায়তায়। তবে তা কখনো কখনো কাজেও যে ব্যাঘাত ঘটায়, তার নজির আরও রয়েছে।

সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া সাংবাদিক মেরিনা মিতু দেখেছেন দুর্যোগের মধ্যেই লোক দেখানো কিছু কাজের।
তিনি ফেইসবুকে একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, “বিকাল ৫টা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কীভাবে সাহসিকতার সাথে প্রথম থেকে দুর্দান্তভাবে উদ্ধারকাজে নিযুক্ত ছিলেন এই বিষয়ে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য খেলাফতে মজলিস ও তাকওয়া ফাউন্ডেশনের দুজন লাইন ধরে আছেন এক টিভি রিপোর্টারের ক্যামেরার সামনে। ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য তার খানিকক্ষণ আগেই এক গ্রুপের তর্ক-বিতর্ক, ধস্তাধস্তিও হয়।
“শুধু এনারা নন, এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ব্যানারে এনসিপির নাম ভাঙিয়ে উদ্ধারকাজে সহযোগিতার ক্যাম্পেইন করতেও চোখে পড়ে এসময়।”
“এই দুর্ঘটনায় সিভিল অনেকেই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি যেই রাজনীতিই করেন না কেন, ওই এলাকার হলে আপনিও স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করতে পারেন, কিন্তু নিজের দলের নাম ভাঙানোর যে প্রতিযোগিতা সেই প্রতিযোগিতার নোংরামি মানুষ জানে, বুঝে। এসব ফুটেজে মানুষ আর বাহবা দেয়না। অনলাইনে জুতা দেয়,” লিখেছেন তিনি।

এরপর বিভিন্ন হাসপাতালে হতবিহ্বল শিশু কিংবা তার অভিভাবকদের সামনে টিভির বুম তুলে ধরে প্রতিক্রিয়া চাওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনার কথাও আসে ফেইসবুকে, ক্ষোভ নিয়ে।
তা দেখে বার্তা সংস্থা এপির ঢাকা ব্যুরো প্রধান জুলহাস আলমকে তাই লিখতে হয়েছে, “মিডিয়া, বিশেষ করে ভিজ্যুয়াল মিডিয়া, প্লিজ সংবেদনশীল হোন। সব বলতে হয় না, সব দেখাতে হয় না। সাংবাদিকতা আর ধারাভাষ্য- এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস হাসপাতালে ভিড় না করার অনুরোধ করলেও তার সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে দেখা গেছে হাসপাতালে যেতে। পুিলশ প্রটোকলে তাদের যাওয়া বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে-বাইরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এরপর জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান সদলবদলে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের দেখতে যান। তখন ভিড়ে রোগী কিংবা তাদের স্বজনদের ঢোকাও কঠিন হয়ে পড়েছিল, যা দেখে স্বেচ্ছাসেবকরা উত্তেজিতও হয়ে ওঠেন।
তা দেখে প্রবাসী সাংবাদিক-কলামনিস্ট মারুফ মল্লিক ফেইসবুকে লেখেন, “এই লোকগুলোর আক্কেল কোনো দিনই হবে না। হাসপাতাল শোডাউনের জায়গা না। যেখানে অ্যাম্বুলেন্স সঠিকভাবে ঢুকতে পারছে না ,সেখানে এত মানুষের প্রটোকল নিয়ে জাশি আমির জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যাচ্ছে। কয়েক উপদেষ্টাও নাকি গেছে। এদের আটকে দেয়া উচিৎ ছিল।”

কিন্তু এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও নেতা-কর্মীর বিশাল বহর নিয়ে ঢোকেন ওই হাসপাতালে। তা দেখে একজন মারুফ মল্লিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি উত্তর দেন, এটা ঠিক হয়নি।
তাদের কাণ্ডকীর্তি রাজনীতিকদের অনেকে মানতে পারছেন না। যুব ইউনিয়নের সভাপতি খাঁন আসাদুজ্জামান মাসুম ক্ষোভ জানিয়ে লিখেছেন, “এই যে যারা শোডাউন করে হাসপাতালের গিয়ে কথিত মানবিক রাজনীতি করলেন! তাতে যে চিকিৎসা ব্যাহত হলো, সেটা কি বোঝেন?”
রাজনীতিক-সাংবাদিকদের এই আচরণকে কাণ্ডজ্ঞান লোপ পাওয়া বলে মনে করছেন লেখক-শিক্ষক সৌমিত জয়দীপ।
তিনি ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “একটা পুরো জাতির কাণ্ডজ্ঞান জাস্ট লোপ পেয়েছে!”
“আজকে দেখছি ভিউ ব্যবসার ছড়াছড়ি! সোশ্যাল মিডিয়ার হোমপেজে জাস্ট স্ক্রল করলেই আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশুদের ঝলসানো দেহ, কখনও ছবি হয়ে, কখনও ভিডিও হয়ে সামনে চলে আসছে।
কারা এসব ছবি তুলছেন, কারা এসব ভিডিও করছেন? কেননননননন……??????
একটা বাচ্চা পুড়ে অঙ্গার হয়ে দৌড়াচ্ছে, ওর ভিডিও ভাইরাল। আহা, কাণ্ডজ্ঞানের বলিহারি! বাচ্চাটাকে কেউ তখনও পর্যন্ত উদ্ধার করেননি, এটাই ধরে নিতে হবে৷ কিন্তু, ক্যামেরা বের করে ঠিকই ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু ভিউয়ের লোভে। আহা, মনিটাইজেশন!
এআই দিয়ে ছবি ও ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে স্যোশাল মিডিয়ায়। উদ্দেশ্য সেই একই, ভিউ ব্যবসা ও মনিটাইজেশন। এসব যেকোনো স্বাভাবিক মানুষকে ট্রমাটাইজ করার জন্য যথেষ্ট। বাচ্চাদের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য।”

হাসপাতালে রাজনীতিকদের ভিড়ে ক্ষোভ জানিয়ে জয়দীপ বলেন, “কী ভিড়! এক মহান নেতা সংবাদ সম্মেলনও করতে চাইলেন। মিডিয়ার ক্যামেরা তার দিকে ছুটছে। হাসপাতালে নাকি তার বাইরে, বোঝা গেল না৷ স্বজনরা বাকরুদ্ধ। এর মধ্যে এই অবস্থা!
“উদ্ধার কাজের সময় মিডিয়াইবা কেন এত টিআরপি পাগল হয়ে উঠে! প্রত্যেকটা ঘটনায় মিডিয়ার এই আচরণ চলতেই থাকে। কে কার আগে বাইট দেখাতে পারে দর্শকদের, সেই প্রতিযোগিতা। এ দেশে কোনো নীতিমালাই আসলে কাজ করে না! আফসোস!”
অনেকে আবার বলছেন, রাজনীতিকরা না গেলে আবার তাদের না যাওয়া নিয়েই সোশাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠত।
জয়দীপ লিখেছেন, “জানি, রাজনীতিকদের সহায়তা জরুরি, মিডিয়ারও জরুরি। কিন্তু, এগুলো দুর্ঘটনা স্পট ও হাসপাতালে না গিয়েও করা যায়। তাতে উপকারটা আরও বেশি হয়।”