নতুন বছরের প্রথম দিনেই শিশুদের হাতে হাতে নতুন বই; উৎসবমুখর পরিবেশ স্কুলগুলোতে, বাংলাদেশে এমনটাই দেখা যাচ্ছিল গত দেড় দশক। কিন্তু এবার সেই দৃশ্য মিলিয়ে যাচ্ছে।
এতদিন স্কুলশিশুদের কাছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার তুলে দিয়ে এলেও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার তা দিতে ব্যর্থ হলো।
বই ছাপানো শেষ করতে না পারায় ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি বই উৎসব আগেই বাতিল করা হয়েছিল। শিশুদের হাতে কমে নাগাদ নতুন বই পৌঁছবে, তাও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বছরের প্রথম দিনেই স্কুলশিশুদেরন হাতে বিনামূল্যের বই পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার।
পাঠ্যবইরে মলাটের পেছনে শেখ হাসিনার নানা বাণী ও সরকারের প্রশস্তিগাথা অনেকের চোখে দৃষ্টিকটূ লাগলেও বই বিতরণের কাজটি ঠিকই চলছিল। এক সময় শুধু প্রাথমিকের পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেওয়া হলেও পরে মাধ্যমিকের বইও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত ১৪ বছরে মোট পাঠ্যবই বিতরণ করা হয় মধ্যে ৪৬৪ কোটি ৭৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৩টি। ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি ভাষার বইয়ের পাশাপাশি অন্ধ শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বইও বিতরণ করা হচ্ছিল।
২০২৪ সালে ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার ৩২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি নতুন বই বিতরণ হয়। তার জন্য ব্যয় হয় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
বিনামূল্যে যথাসময়ে পাঠ্যবই বিতরণের কারণে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথাও বলছিলেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রমের বই বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি ইতিহাসসহ বিভিন্ন বই নতুন করে লেখারও সিদ্ধান্ত হয়।
এর ফলে বই তৈরি এবং ছাপানো ঠিক সময়ে না হওয়ায় এখন বই ছাড়াই নতুন ক্লাসে বসতে হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরের প্রথম দিন এবার নতুন কোনো পাঠ্যবই হাতে পাবে না প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর মাধ্যমিকে শুধু দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির শুরুতে কিছু বই পাবে।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিপুল সংখ্যক বই ছাপার কাজ শেষই করতে পারেনি এনসিটিবি। ৪০ কোটির বেশি বইয়ের মধ্যে গত শনিবার পর্যন্ত মাত্র পৌনে ৫ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় এবার বছরের প্রথম দিনই সব পাঠ্যবইয়ের সফট কপি অনলাইনে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি।
বই বিতরণের কী হাল?
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা আশা দিচ্ছেন, ২০ জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছে যাবে। তবে বাস্তব চিত্রে তার ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক আবু নাসের টুকু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপানোর কাজের ৯৮টির মধ্যে ২৭টি দরপত্রের লটের বই পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবে। বাকিরা প্রথম দিনই পেয়ে যাবে। চতুর্থ, পঞ্চম ও প্রাক-প্রাথমিকের ক্ষেত্রেও কিছুটা দেরি হবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব উপজেলার প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছি, সেভাবেই কাজ চলছে। আর এ শ্রেণিগুলোর অন্যান্য সব বই চলে যাবে ২০ জানুয়ারির মধ্যে।”
নতুন শিক্ষাক্রমে চলতি বছরের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভাগ-বিভাজন ছিল না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ফিরিয়ে এনেছে পুরনো শিক্ষাক্রম। সেখানে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ বিভাজন নিয়ে তারা নতুন বছরে দশম শ্রেণিতে পড়বে। সেভাবেই ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিত হবে তাদের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
এক শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণি আর আরেক শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণিতে পড়তে হওয়ায় দশম শ্রেণির নতুন শিক্ষার্থীদের বইগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পৌঁছে দিতে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ছাপা শুরু করে এনসিটিবি।
বোর্ডের চেয়ারম্যান রিয়াজুল জানান, দশম শ্রেণির বইগুলো ৫ জানুয়ারির মধ্যে সব উপজেলার শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে পারবেকন বলে তারা আশাবাদী।
কিন্তু ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ বই আসতে দেরি হবে। এসব শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের বই ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব উপজেলায় পৌঁছে দিতে পারার আশা করছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা।
আপাতত ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব উপজেলার প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে এনসিটিবি। বাকি সব শ্রেণির অন্যান্য সব বই ২০ জানুয়ারির মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
কেন এই হাল?
পরিমার্জনের পর ছাপানো শুরুতে দেরি হওয়া, কাগজ সংকট ও তদারক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনে দেরি হওয়ায় মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজ পিছিয়ে আছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, “আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ করেছি। এখন সপ্তম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বইয়ের কাজ করছি। সপ্তম শ্রেণির বইগুলোর কাজ শেষ হলে আমরা চতুর্থ শ্রেণির বইয়ের কাজ শুরু করব।”
তিনি বলেন, “মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির তিনটি বই ছাপানোর কাজ চললেও তা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে না। এজন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে।”
বই মুদ্রণের দায়িত্ব পাওয়া প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ‘লেটার এন কালার’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ সিরাজ উদ্দিন বলেন, প্রথম দিন প্রাথমিকের ৭৫ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ বই শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
কাগজ সংকটের বিষয়টি তুলে ধরে আনোয়ার হোসাইন বলেন, “সবগুলো প্রেস এক সঙ্গে ছাপার কাজ শুরু করেছে। তাই কাগজের সংকট আছে। এমন পরিস্থিতিতে মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ শেষ করতে প্রেসগুলো হিমশিম খাচ্ছে।”
এনসিটিবির বিতরণ উপ-নিয়ন্ত্রক মাহমুদা খানম বলেন, “আগের টেন্ডার বাতিল করে নতুন টেন্ডার হয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বর, যা প্রতিবছর হয় জুনে। তাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি।”
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে অন্ততপক্ষে তিনটি করে নতুন বই (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) দিয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু করার পরিকল্পনা এনসিটিবি করলেও বই ছাপার যে পরিস্থিতি, তাতে সেই পরিকল্পনাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এনসিটিবি কর্মকর্তা ও মুদ্রণকারীদের বরাতে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই ছাপায় অগ্রগতি ভালো। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার অগ্রগতি খুবই কম। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়া, দেরি করে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করাসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এবার এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এখনো বেশ কিছু পরিমাণ বই ছাপার জন্য মুদ্রণকারীদের সঙ্গে চুক্তিপত্র সইয়ের কাজটিও শেষ হয়নি। ফলে ফেব্রুয়ারির আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছানো কঠিন হবে বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রথম আলো জানিয়েছে, এবার প্রাক্–প্রাথমিক পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৯ কোটি ৬৪ লাখের মতো। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ৪ কোটি ৩৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৩ কোটি ৪৭ লাখের মতো বইয়ের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) মোট বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখের মতো। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত ১ কোটি ৩২ লাখের মতো বইয়ের ছাড়পত্র হয়েছে।