ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি বলে দাবি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন দাবি করে তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক “এখনও ভালো আছে, ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে।”
সোমবার বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি দেখা গেছে উল্লেখ করে দুই দেশের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে চাওয়া হয় মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে।
জবাবে তিনি সম্পর্ক ভালো আছে দাবি করে আরও বলেন, “বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভালো না থেকে উপায় নেই। আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, আমাদের পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি এবং ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এত ক্লোজ সম্পর্ক, সেটা থেকে আমরা বিচ্যুত হতে পারবো না।
“তবে মাঝখানে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, আমি বলেছি মেঘ দেখা দিয়েছে। এই মেঘগুলো মোটামুটি এসেছে অপপ্রচার থেকে। অপপ্রচারের সূত্র কারা সেটা অন্যরা বিচার করবে। কিন্তু এই অপপ্রচারের ফলে আমাদের সঙ্গে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। সেই ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি।”
ভারত সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে কি না জানতে চাওয়া হলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সবসময় যোগাযোগ হচ্ছে। তারা এখানে আসছে, আমাদের লোকজন সেখানে যাচ্ছে। প্রাইম মিনিস্টার মোদীর সঙ্গে আমার প্রথম সপ্তাহেই কথাবার্তা হয়ে গেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনে সরকারের দক্ষতা বাড়ানো বিষয়ক দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়া বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ এবং তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্টারলিংককে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর আহ্বানের প্রসঙ্গও উঠে আসে সাক্ষাৎকারে।
এটি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা কি না জানতে চাইলে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “এটা মূলত ছিল স্টারলিংক নিয়ে। এটা ব্যবসায়িক একটা সম্পর্কের বিষয় ছিল। সে বিষয়ে আমরা আলাপ করছি যে স্টারলিংকের কানেকশনটা আমরা নিতে চাই।”
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘিরে মানুষের আতঙ্কিত হয়ে পড়ার বিষয়টি উঠে আসে সাক্ষাৎকারে। বিষয়টির উল্লেখ করে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি দাবি করেন, “অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি। আগের মতোই হয়েছে।”
এ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন মুহাম্মদ ইউনূস।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংস্কারের শেষে নির্বাচন আয়োজনের ওপর জোর দেওয়া হলেও এখন বলা হচ্ছে ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে। এই সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ হবে কিনা জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আমরা একেবারে প্রত্যেকটা সুপারিশ দেবো। সুপারিশের সঙ্গে কথা থাকবে যে, আপনার রাজনৈতিক দল এটা কি সমর্থন করে? এটাতে রাজী আছেন? রাজী থাকলে বলেন, রাজী না থাকলে বলেন। বা এই যে সুপারিশটা আছে সেটার মধ্যে যদি কোনো একটা সংশোধনী এনে রাজী হবেন, সেটা বলেন।”

এটা কি নির্বাচনের আগে সংশোধন করা ঠিক হবে নাকি নির্বাচনের পরে– সব প্রশ্নের এখানেই সমাবেশ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলকে শুধু বলতে হবে কোনটা? সবকিছু মিলালে আমরা এটা ঠিক করবো কোন সুপারিশে সবাই একমত হয়েছে। সেটা আলাদা করবো যে এটাতে সবাই একমত হয়েছে। এরকম যে সমস্ত সুপারিশে তারা একমত হয়েছে, সেগুলো আমরা আলাদা একটা কাগজে নিয়ে আসবো যে এইসব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। তবে এটাকে আমরা বলবো একটা চার্টার– জুলাই চার্টার।
“এবং সবাইকে আহ্বান জানাবো, আপনারা সবাই যেহেতু একমত হয়েছেন এটাতে সই করে দেন। জুলাই চার্টারের মতোই আমরা চলবো। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নির্বাচনটা হবে। নির্বাচনের আগে যেটা বলেছেন সেটা নির্বাচনের আগে হবে, যেটা নির্বাচনের পরে বলেছেন সেটা নির্বাচনের পরে হবে। এটা আপনাদের বিষয়। কিন্তু আপনারা একমত হয়েছেন। সেই ঐকমত্যই আমরা গঠন করার চেষ্টা করছি।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে মুহাম্মদ ইউনূস এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, “আমার বরাবরই পজিশন হলো যে আমরা সবাই এই দেশের নাগরিক। আমাদের এই দেশের ওপরে সমান অধিকার। আমরা সব ভাই ভাই। আমাদেরকে এই দেশেই বাঁচতে হবে। এ দেশকেই বড় করতে হবে। কাজেই যে মত-দল করবে, তার মতো করে, সবকিছু করবে। এই দেশ থেকে কারও অধিকার কেড়ে নেয়ার কোনো উপায় নাই। কিন্তু যে অন্যায় করেছে, যার বিচার হওয়া উচিৎ, তার বিচার হতে হবে। এটুকুই শুধু।”
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিষয়টি উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে কি না জানতে চাওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরেছে। এরকম কোনো ঘটনা ঘটে নাই।”
ছাত্রদের নেতৃত্বে নতুন যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, তা সরকারের সহায়তায় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মুহাম্মদ ইউনূস তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “সরকার কোনো সহায়তা করে না। যে রাজনীতি করতে চায়, সে নিজেই ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে। তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি ছিল সরকারের ভেতরে। যিনি রাজনীতি করতে মন স্থির করেছেন, তিনি ইস্তফা দিয়ে সরকার থেকে চলে গেছেন। উনি প্রাইভেট সিটিজেনশিপে রাজনীতি করবেন, কার বাধা দেওয়ার কী আছে?”