দেড় দশককাল আগে তিউনিসিয়া দিয়ে শুরু করে একের পর এক আরব দেশে অভ্যুত্থানকে ‘আরব বসন্ত’ নাম দিয়েছিল পশ্চিমা মিডিয়া; তেমনি গত বছর বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের নাম দেয় ‘বর্ষা বিপ্লব’।
জুলাইয়ের এই অভ্যুত্থানের সময়কাল ছিল বাংলার ঋতুচক্রে বর্ষাকালে। বাংলার বর্ষা যে কী, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। জল-কাদায় নাকানি-চুবানি অবস্থা হয়েছিল তাদের।
৫৩ বছর পরের এক বর্ষায় ক্ষমতাচ্যুত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ। অবসান হয় শেখ হাসিনার সরকারের, যাকে কর্তৃত্ববাদী শাসকের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়।
শেখ হাসিনার এই দেড় দশকের শাসনকালে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট আর মত প্রকাশের অধিকার হরণের মতো নানা অভিযোগ ওঠে বিরোধী মহল থেকে; রাতের ভোট কিংবা নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টাও দেখা গেছে দেড় দশকের বিভিন্ন সময়।
ঘোর বর্ষায় জুলাই আন্দোলনে তাই মানুষ মুক্তির আকাঙ্ক্ষার পালে হাওয়া দিয়েছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যে সেই আশায় নিরাশা দেখা দিয়েছে তাদের মনেও, যারা সেই জুলাইয়ে রাজপথে নেমেছিলেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যখন বৈষম্য বিলোপের আওয়াজ উঠেছিল, তখন অনেকে সরাসরি, অনেকে মনে মনে সেই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।
রক্তাক্ত এক পথ মাড়িয়ে জুলাইয়ের আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে, তাতে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের পছন্দে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হন মুহাম্মদ ইউনূস।
কিন্তু তারপর এক বছর গড়ালেও পরিবর্তন কি কিছু হয়েছে?
আগের মতোই প্রভাব বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, চাকরি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়গুলো বন্ধ তো হয়নি, বরং বেড়েছে বলেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এমনকি আন্দোলনের নেতাদের কেউ কেউ জুলাইকে ‘মানি মেকিং মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠছে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই।
আন্দোলনকারী নেতারা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নামে যে নতুন দল গড়েছেন, তা আওয়ামী লীগের মতোই রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, যিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত একটি সংস্কার কমিশনের প্রধান।
যে আন্দোলনে নারীরা লড়ছে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে, অভ্যুত্থানের পর নারীদের হেনস্থা করার ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। অভ্যুত্থানের পর বলীয়ান হয়েছে ধর্মীয় গোষ্ঠী, তারা চাইছে নারীদের পর্দার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে।
স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা বেড়েছে অনেক। তাদের মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টাও হচ্ছে।
মত প্রকাশে কেউ হুমকি দিচ্ছে না, তবে মত প্রকাশের পর মব সন্ত্রাসের শিকার হতে হবে না, সেই নিশ্চয়তা দেওয়ার কেউ নেই। টিআইবির পর্যবেক্ষণ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি।
জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব এখনও প্রকট, অভ্যুত্থানের পর জনরোষের মুখে পড়া পুলিশ এখন উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
সার্বিক অবস্থায় আওয়ামী লীগের মতো স্বৈরতন্ত্রই দেশে এখন দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ; যিনি গত বছরের ২ আগস্ট দ্রোহযাত্রার কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন।
সেই দ্রোহযাত্রার বার্ষিকীতে গত শনিবার এক সমাবেশে তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে আমরা শেখ হাসিনা সরকারের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। সেই একই রকম স্বৈরতন্ত্র, একই রকম জনগণের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন, একই রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।”
অভ্যুত্থানের সরকার হিসেবে পরিচয় দেওয়া ইউনূসের সরকার জনপ্রত্যাশা ভঙ্গ করেই এক বছর পার করেছে মন্তব্য করে নতুন দ্রোহযাত্রার হুঁশিয়ারিও দেন এই অধ্যাপক।
পরিবর্তনের আশা দেখিয়ে সরকার গঠন করলেও প্রশাসনে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই। এনিয়ে উন্নয়ন অর্থনীতির গবেষক মাহা মির্জা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অভ্যুত্থানের পর আমলারা বদলে গেছেন তেমনতো না। সেই আওয়ামী আমলের যেই আমলাতন্ত্র, যেটা নিপীড়নমূলক আমলাতন্ত্র, যে আমলারা মানুষকে মানুষ মনে করতেন না, যে কারণে আমাদের এখানে এরকম অশ্লীল একটা ভিআইপি কালচার তৈরি হয়েছিল, সেই মানুষগুলোই তো আসলে তাদের পদগুলোতে রয়ে গেছে।”
ইউনূস সরকারের সব উপদেষ্টা মন্ত্রিপাড়ায় থাকলেও সচিবালয়ে যাতায়াতে আগের মতোই প্রটোকলসহ ব্যক্তিগত বাহন ব্যবহার করছেন, যা অপচয় মনে করছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস।
আগের মতোই চলছে বদলি কিংবা নিয়োগ বাণিজ্য। তাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতারাই জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পদত্যাগী মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, জুলাইকে ‘মানি মেকিং মেশিনে’ পরিণত করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে এনসিপি গঠনের পর সরকারিভাবে তাদের নানা পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ উঠছে একের পর এক।
কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে অভ্যুত্থান হলেও ৫ আগস্টের পর নানা ‘কোটা’ই আবার ফেরে বলে দাবি করেন হাসিবুর ইসলাম নাসিফ, যিনি এসব দেখে সহ-সমন্বয়কের পদ ছেড়ে দেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পাঁচ আগস্টের পরে কোটার আঁতুড়ঘর হয়ে গিয়েছিল। ভাই, বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র ইত্যাদি কোটায় মানুষজনকে বিভিন্ন কমিটি, পজিশন দেয়া হচ্ছিল।”
সেপ্টেম্বরের দিকে সরকারি খরচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভাগীয় সফর হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন নাসিফ। তিনি বলেন, “আমরা রাষ্ট্রের কোনো অংশও তখন ছিলাম না। কিন্তু রাষ্ট্র যখন আমাদের খরচ বহন করছে, সেটা পুরোপুরি আনইথিক্যাল, ইমমোরাল এবং অবৈধ।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে যারা সরকারে গেছেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধেও। কুমিল্লার মুরাদনগরে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার বাবার বিরুদ্ধে। কয়েক মাস আগে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে আসিফ মাহমুদসহ আরও এক উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
নিজ জেলায় শত শত গাড়িবহর নিয়ে মিছিল করার কারণে সমালোচনার মুখে পড়েন এনসিপি নেতা সারজিস আলম।
মব তৈরির চেষ্টা করাদের মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনায় শোকজ করা হয়েছিল হান্নান মাসউদকে।
অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, “তারা আসলে শিখেছে কোথা থেকে? তাদের গ্রুমিং হয়েছে কোথায়? তারা বেড়ে উঠেছে কোথায়? তারা রাজনৈতিক নেতা হওয়া বলতে কী বোঝে? এলাকায় যাওয়া বলতে কী বোঝে? তারা যা দেখেছে, তা-ই করছে। ফলে বাস্তবে কোনো বড়সড় পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”
জুলাই ‘বাঁচার আন্দোলন থেকে বেচার আন্দোলন’ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অনেকে; সেই কারণে দ্রোহযাত্রার ব্যানার উঠেছিল- ‘বাঁচার জন্য জুলাই, বেচার জন্য নয়’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই আন্দোলনের মুখ ইসরাত জাহান ইমু বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রত্যেকটা জায়গায় জুলাইকে নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু জুলাই নিয়ে জনগণের মূল আকাঙ্ক্ষার জায়গা যেটা ছিল সেটা আসলে কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হয়নি।”
অভ্যুত্থানের পরপরই নারীদের প্রতি বৈষম্যের প্রকাশ বেশি করে ঘটতে থাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সহ-সমন্বয়ক মাইশা মালিহা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আন্দোলনটার পর আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল এই ব্যাপারগুলো দূর হবে। রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের মধ্যে এই সংস্কারটা আসবে। কিন্তু আমরা বাস্তবতায় দেখছি এরকম কিছু হচ্ছে না। বরং নারী হেনস্তাকারীদেরকেই ফুলের মালা দিয়ে সমাজে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।”
আওয়ামী লীগ আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা নিয়ে উচ্চ কণ্ঠ টিআইবি অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে মব তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এনসিপিকে কিংস পার্টি আখ্যায়িত করে বলেন, ৫ আগস্ট থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি শুরু করে এবং গত এক বছর ধরে তা আরও বেড়েছে। এর ফলে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের জন্মলগ্ন থেকে একই পথ অনুসরণ করেছে। দখলবাজি, চাঁদাবাজির মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হয়েছে।
তিউনিসিয়ার বেন আলিকেও কর্তৃত্ববাদী শাসনের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে একটানা ২৪ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে জনবিক্ষোভের মুখে তিনি পালিয়ে যান সৌদি আরবে। বিজয় হয় অভ্যুত্থানের।
তিউনিসিয়ার মতো বাংলাদেশে জুলাই আন্দোলন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগে বাধ্য করে।
আরব বসন্তের দমকা হাওয়ায় তিউনিসিয়ায় বেন আলিকে ক্ষমতা থেকে ছিটকে দিলেও এক যুগেও সেখানে আমূল কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বাংলাদেশে ‘বর্ষা বিপ্লব’ একাত্তর নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়ে দেশের মূল অস্তিত্বেই টান ফেলেছে। এই কর্দমাক্ত-পিচ্ছিল পথে খাবি খাওয়া বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াবে কীভাবে, তা নিয়ে কৌতূহল এখন পর্যবেক্ষকদের।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: