ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এ পর্যন্ত নিহতের যে তথ্য মিলেছে তাতে সনাক্ত হওয়া মরদেহের সংখ্যা বিশে পৌঁছেছে। তবে সনাক্ত করা যায়নি, অথবা বিস্ফোরণে দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে- এমন শিশুর সংখ্যা দেড়শ’র বেশি বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য।
সোমবার বেলা ১টার পর বাংলাদেশের বিমানের একটি প্রশিক্ষণ বিমান আছড়ে পড়ে মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনে, যে ভবনটি ছিল মূলত স্কুলের জুনিয়র শাখা। অর্থাৎ সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের পাঠদান করা হতো।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, দুর্ঘটনার পর যারা বের হতে সক্ষম হয়েছিল তাদের বেশিরভাগের অবস্থা ছিল ক্ষতবিক্ষত। শরীর থেকে কারো চামড়া খসে গেছে, মাথার মধ্যে একফোটা চুল নেই, মুখের চামড়া হাতের চামড়া সব উঠে গেছে। কারো কারো চোয়ালের মাংস পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।
সে বলে, “বিমানটি স্কুলে পড়ার পর ফায়ার সার্ভিস আসতে অনেক দেরি হচ্ছিল। এর মধ্যেই কিছু শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিক মারা গেছে, কিছু দৌড়ে দৌড়ে আসছিল যারা পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসার পর আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু হয়।”

তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে সে কী দেখতে পেয়েছিল? তখন ওই শিক্ষার্থী বলে, “ভেতরে জানালার (গ্রিলে) মধ্যে বাচ্চাদের হাত ঝুলে ছিল। আগুনের তাপের কারণে হাত ঝুলে আছে কিন্তু বডি নিচে পড়ে আছে। যেখানে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে দেহগুলো একটার পর একটা মণ্ডের মতো হয়ে গেছে। চোখটোখ একদম গলে গেছে। বডি সনাক্ত করা একদম ইমপসিবল ছিল।”
প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ওই শিক্ষার্থীর কাছে নিহতের সংখ্যা জানতে চাইলে সে বলে, “বাচ্চাদের বডি তো এমনিতেই ছোট। কয়েকটা স্তূপ পড়ে ছিল। এখানে প্রত্যেকটা ক্লাসে লাশ পড়ে ছিল। মিনিমাম দেড়শ প্লাস হবে।”
অবশ্য আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) তথ্য অনুযায়ী, বিধ্বস্ত হওয়া প্রশিক্ষণ বিমানের পাইলটসহ ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭১ জন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মুহাম্মদ জাহেদ কামালও উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ২০ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন।
আর হাসপাতালে দেড় শতাধিক আহতের তথ্য নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অভিজিৎ। এছাড়া অন্যান্য হাসপাতালেও শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বলছেন, দগ্ধদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। তবে তাৎক্ষণিকভাবে দগ্ধদের সবার নাম পরিচয় জানা যায়নি।
সিনিয়র সংবাদিক বিশ্বদীপ দাশ ফেইসবুকে এক পোস্টে জানিয়েছেন, “আমার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাচ্চাদের স্কুলের ভিতরে যে কয়জন হাতেগোনা সাংবাদিক বাঁধা ডিঙিয়ে ঢুকতে পেরেছিলেন, তাদেরকে বার বার বাঁধা দিয়েছেন, শার্ট, জামার কলার ধরে টানাটানি করেছেন। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছেন।
“ভিডিও করার সময় ক্যামেরার সামনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে দাঁড়িয়ে পড়েন যাতে দৃশ্য ধারণ না করা যায়, তারপরও যারা চেষ্টা করছিলেন, তাদের গ্রেপ্তার করবেন বলে হুমকি দিচ্ছিলেন।
উত্তরা এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বদীপ দাশ।
তিনি লিখেছেন, “আরও একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, ওই এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল, যেন কেউ লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার করতে না পারেন।
“স্কুল চত্বরের বাইরে দাঁড়ানোরও অনুমতি দেওয়া হয়নি, সাংবাদিকদের অনেক দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়। এমনকি হাসপাতালে বার্ন ইউনিটেও সেনাসদস্যদের বাঁধা ও রূঢ় আচরণের শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা।”
তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, এত বড় এক মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে, যখন সবাইকে—বিশেষ করে নিখোঁজ বাচ্চাদের উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েদের—তথ্য জানানো অত্যন্ত জরুরি, তখন সেনাবাহিনী কেন সংবাদকর্মীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের পথে গেল?
বিবিসি বাংলা লিখেছে, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতালে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে আছেন। তাদের মধ্যে অনেকে এসেছে আহতদের সাথে আর অনেকে এখনো স্বজনদের খুঁজছেন।
এই স্বজনদের অনেকে তাদের সন্তানদের ছবি নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছেন। এই হাসপাতালেও তারা স্বজনকে খুঁজতে এসেছিলেন।
প্রাথমিকভাবে এই হাসপাতালে ৬০ জন ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকে অন্যান্য হাসপাতালে চলে গেছেন। এখনো ২৩ জন ভর্তি রয়েছেন।
এদিকে, বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধদের বেশিরভাগের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে বলে জানিয়েছে বার্ন ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, সেখানে থাকা ৩২ জনের মধ্যে ৬ জন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তারা হলেন, নাফিস, শামিম, শায়ান ইউসুফ, মাহিয়া, আফনান ও সামিয়া। নাফিসের শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।
বাকি ২৬ জনের মধ্যে এরিকসন ও মেহরিনের শরীরের শতভাগ দগ্ধ হয়েছে। দুজনের দগ্ধ হয়েছে ৮০ শতাংশ করে। তারা হলেন ১৩ বছর বয়সী নাজিয়া ও মাহতাব।

১৫ বছর বয়সী মাকিনের ৬২ শতাংশ পুড়ে গেছে, ৬০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে আয়ান ও মাসুমার।
অন্যদের মধ্যে তাসনিয়ার ৩৫ শতাংশ, ১১ বছর বয়সী আরিয়ানের ৫৫ শতাংশ, আশরাফুল ইসলামের ১৫ শতাংশ, রোহানের ৫০ শতাংশ, শ্রেয়ার ৫ শতাংশ, কাব্য ২০ শতাংশ, ইউশা ৬ শতাংশ ও রূপী বড়ুয়ার ৬ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
এছাড়া তাসমিয়া ৫ শতাংশ, জায়ানা ৮ শতাংশ, সাইবা ৮ শতাংশ, পায়েল ১০ শতাংশ, আবির ২০ শতাংশ, কাফি আহমেদ ১০ শতাংশ, মুনতাহা ৫ শতাংশ, আলবিনা ৫ শতাংশ ও নিলয়ের শরীরের ১৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
নওরিন ও মাসুকা নামের দুজনের বয়স কিংবা দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তালিকায় ছিল না।
এ সংক্রান্ত আরও খবর: