সাড়া পেলেন না পিনাকী, অক্ষত সিপিবি কার্যালয়

Pinaki's call goes unanswered

ঢাকার পুরানা পল্টনে সিপিবির কার্যালয়কে ‘ছাত্র-জনতার কার্যালয়’ বানানোর ডাক দিয়েছিলেন লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। কিন্তু এবার আর তার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। অফিস দখল তো দূরের কথা, ১০ জন ‘তৌহিদী-জনতা’ সেখানে অবস্থান করেনি।

অভিযোগ রয়েছে, এই পিনাকী ভট্টাচার্য’র ডাকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ‘তৌহিদী-জনতা’।

একই ভাবে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই দিয়ে ‘জিয়াফত’ কর্মসূচি পালন করেছিল সেই ‘তৌহিদী-জনতা’। দুটি পত্রিকার অফিসের নিরাপত্তা দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছিল সেনাবাহিনীকে।

প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের অফিস রক্ষা পেলেও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি সেনাবাহিন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার একাজে কোনো বাঁধা দেয়নি।

পিনাকী ভট্টাচার্যের বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কার্যালয়কে ‘ছাত্র-জনতার কার্যালয় বানানোর ডাককে’ ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। সবাই আশঙ্কা করেছিল সিপিবির অফিসটি আর সেখানে থাকবে না।

সিপিবি কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীরা

জাতিসংঘের মহাসচিবের ঢাকা সফরের সময় পিনাকী এই উত্তেজনা তৈরির চেষ্টায় রীতিমত ভড়কে যায় মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। তাই অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শনিবার সকাল থেকেই কার্যালয়টির সামনে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকশ সদস্য। ছিল সেনাবাহিনীর টহল।

যদিও পিনাকীর হুমকিতে দমে যায়নি সিপিবি। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, সকাল সাড়ে ১০টার কার্যালয়ের সামনে এসে কালো পতাকা উত্তোলন করেন দলটির সভাপতি কমরেড শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। এতে অংশগ্রহণ করবেন বাম ঘরানার অন্যান্য কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরাও।

এসময় সিপিবির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স তিনি বলেন, “অনেকে ক্ষমতার পরিবর্তন চান, কিন্তু ব্যবস্থার পরিবর্তন চান না। তারা তাদের পরিস্থিতি ঠিক রাখতে চায়। একমাত্র বামপন্থী এবং কমিউনিস্টরা জনগণের মুক্তির জন্য কথা বলে।”

এ সময় নেতাকর্মীরা ‘কমরেড, কমরেড, ভেঙে ফেলো ব্যারিকেড’, ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও লড়াই করো’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।

সিপিবির শোক মিছিল

শনিবার বিকেলে দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শোক মিছিল বের করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি। এসময় কয়েকশ’ নেতাকর্মী লাল ও কালো পতাকা আর বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্লাকার্ড হাতে নিয়ে মিছিলে যোগ দেন।

ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়া হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও নারীবিরোধী প্রচারণা বন্ধের দাবি জানানো হয়।

মিছিলটি পল্টন মোড় থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যায়। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।”

বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার উগ্রপন্থা শক্তিকে দমন করতে পারছেনা, সেই সঙ্গে দেশকে গণতন্ত্রের পথে এখনো নিয়ে যেতে পারেনি।”

অপরাধীদের বিচার না হওয়ায় আছিয়ার মতো শিশুকে প্রাণ দিতে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সমাবেশ করে বামপন্থী ছাত্র, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

এদিকে পূর্বঘোষিত গণমিছিল কর্মসূচি স্থগিত করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সমাবেশ করেছে বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার পরে শহীদ মিনারের পাদদেশে সমাবেশ শুরু হয়ে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শেষ হয়।

সমাবেশ থেকে নারী ও শিশু নিপীড়ন, ধর্ষণ, খুনের বিচার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।

সমাবেশে লিখিত বক্তব্য দেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দীন।

এতে বলা হয়, “মাগুরার শিশুটির মৃত্যুতে সারা দেশ শোকাহত। কিন্তু ওই শিশুর মতো ঘটনা বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। বরগুনায় কিশোরী ধর্ষণ, বিচার চাওয়ায় কিশোরীর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। সরকার ধর্ষকদের বিচার করতে না পারলেও ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলনকারী ওপর খড়্গহস্ত হয়েছে। পুলিশ দিয়ে হামলা করে পরবর্তী সময়ে তাদের নামেই মামলা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্রমাগত অভ্যুত্থানের চেতনা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। সব নাগরিকের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।”

লিখিত বক্তব্যে ৭টি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে, ১. সব হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নের বিচার করতে হবে। ২. ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অপসারণ করতে হবে। ৩. জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। ৪. মসজিদ, মন্দির, মাজারে হামলাকারী মব সন্ত্রাসীদের বিচার করতে হবে। ৫ . চট্টগ্রাম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ ও যৌথ বাহিনী দ্বারা শ্রমিক হত্যার বিচার করতে হবে। ৬. সাগর-রুনি, তনু, আফসানা, মুনিয়াসহ পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ আমলে সংগঠিত হত্যার বিচার করতে হবে। ৭. হিন্দু ও ক্ষদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঘরবাড়িতে হামলা—লুটপাটের বিচার করতে হবে।

এসময় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, “আমাদের এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, আমরা যেন এই কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করি, পালন না করি। হামলার ভয় ভীতি দেখিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না।”

“দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের যে গণমিছিল হওয়ার কথা ছিল শহীদ মিনার থেকে টিএসসি পর্যন্ত। সেই গণমিছিল স্থগিত করে আমাদের আজকের কর্মসূচি এখানেই সমাপ্ত করছি।”

গণমিছিলের উদ্যোগ নেওয়া দলগুলো ছিল—বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ উদিচী শিল্পীগোষ্ঠী, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)।

এই কর্মসূচির বিপরীতে শুক্রবার দিবাগত মধ্য রাতে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে পুরানা পল্টনে সিপিবি কার্যালয়কে ‘ছাত্র-জনতার কার্যালয়’ বানানোর ডাক দেন লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য। এমনকি ভবনটিতে থাকা দোকানও না খোলার ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন তিনি।

পিনাকীর ডাকে কেউ সাড়া না দেওয়ায় সোশাল মিডিয়ায় ট্রল চলছে।

আযম খান নাম একজন লেখেছেন, “আজকে পিনাকী মব তৈরি করে লাকি এবং সিপিবি অফিসে হামলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে একটা জিনিষ প্রমানিত। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন না থাকলে কোনো মব কখনো সফল হয় না।”

“ধানমন্ডি ৩২ থেকে শুরু করে প্রতিটা মব ভায়োলেন্সে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল। বিশেষত জামায়াত এবং বিএনপির। জামায়াত এখন ক্ষমতার ৭০ ভাগ ভোগ করছে, আর ৩০ ভাগ বিএনপি। জামায়াত চায় না তাদের এই কমফর্টেবল পরিস্থিতিতে বিঘ্ন ঘটুক। আর বিএনপি জানে যত বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে ইলেকশন তত পেছাবে। ১০০ ভাগ ক্ষমতা ভোগ করা সেক্ষেত্রে শিগগিরই হবে না। যে কারণে আজকে এই দলগুলো পিনাকীর এইবারের মব তৈরির উদ্যোগে সাড়া দেয় নি। ফলাফল হলো মব করার লোক নাই।”

“পিনাকী যতই আত্মপ্রেমে মশগুল হোক আর বাঘ-হাতি শিকারের ক্রেডিট নিক, জামায়াত-বিএনপির সমর্থন ছাড়া দেশে তার একটা মাছি মারার ক্ষমতাও নাই।”

তোফাজ্জল হোসেন নামের একজন লিখেছেন, “মব বলতে কিছুই নেই। ভিন্ন ভিন্ন নামে ওরা প্রকৃতপক্ষে জামায়াত শিবির ও বিএনপির একটি অংশ । তারা কখনো বৈষম্য বিরোধী, কখনো ছাত্র জনতা, কখনো ইনকিলাব মঞ্চ, কখনোবা তৌহিদী জনতা।”

আহমেদ ইফতেখার লিখেছেন, “সহজ ভাষায় সুন্দর লজিক-দেশে বর্তমানে কারা মব করছে তা সাধারণ জনগন বুঝে গেছে। এটি এমন না যে রকেট সাইন্স।”

তানজিল হোসেন লিখেছেন, “ধানমন্ডি ৩২ ভাঙ্গার পিছনে সরাসরি জড়িত জামায়াত-বিএনপি। সাধারণ শিক্ষার্থী বা জনগণ কেউ আসেনি।”

মিতা মেহেদী নামের একজন লিখেছেন, “বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-র ঐতিহ্যবাহী কার্যালয় মুক্তি ভবন নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন পিনাকী ভট্টাচার্য। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, মুক্তি ভবন আমাদের সংগ্রামের প্রতীক, এটি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছামতো দখল বা উচ্ছেদ করার জায়গা নয়। যারা জনগণের অধিকার, শ্রমিক-কৃষকের লড়াই, এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকে দমন করতে চায়, তারা ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, কমিউনিস্টরা কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না। এই ধরনের উসকানি ও দখলদার মানসিকতার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াবো।”

শহীদুল ইসলাম সাগর লিখেছেন, “সিপিবি অফিস দখলের ডাক পিনাকীর; কেউ সাড়া দেয়নি। কেউ সাড়া দেয়নি, এটা কোন নিউজ না। ইনকিলাব মঞ্চ তো বলেই দিয়েছে যে ১০ লাখ টাকার নিচে কোন ভাংচুর তারা করতে পারবে না। আর গরু জবাই করেই শাহবাগে লোক জড় করতে পারছে না, সেখানে রোজা রমজানের দিনে খালি পেটে কে যাবে দখল করতে।”

রেজওয়ান হক মুক্ত লিখেছেন, “একাধিক ছদ্মবেশী পিনাকী একসাথে মাঠে নেমেছে, ওরা সিপিবি -বাসদ কে আওয়ামী লীগ দালাল ট্যাগ দিয়ে সিপিবি অফিস দখল করতে চায়। সিপিবি’র উচিত ওইসব ছদ্মবেশী পিনাকীদের সবার আগে প্রতিহত করা।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads