আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে ‘নজিরবিহীন’ নির্দেশনা পুলিশের

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও পুলিশের লোগো।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও পুলিশের লোগো।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঠেকাতে এক নজিরবিহীন জরুরি বার্তা জারি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ, যেখানে প্রতিটি থানার ওসিকে নির্দেশগুলো ‘অবশ্য প্রতিপালন’ করতে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীদের প্রতিহত করতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এনসিপির সাহায্য নিতে বলা হয়েছে সংস্থাটির সদরদপ্তর থেকে।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকার গোয়েন্দা তথ্যে জানতে পেরেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে গোপনে তৎপরতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। সংগঠনের প্রতিটি ইউনিট থেকে দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ নেতাকর্মীকে এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় জড়ো হতে নির্দেশ দিয়েছে দলটি।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আলোকে পুলিশ বাহিনীও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে, যার অংশ হিসেবে বাহিনীর সদস্যদের জন্য ওই বিশেষ নির্দেশ জারি করা হয়।

মোট আটটি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, ১. সকলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা; ২. যাদের বিরুদ্ধে মামলা মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা; গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করা; ৪. নৌ-ঘাট. রেল স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডের উপর নজরদারি করা; ৫. স্থানীয় রাজনৈতিক বৃন্দের (বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি) সহযোগিতা নিয়ে ঢাকামুখী কার্যক্রম প্রতিহত করা; ৬. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সাইট পর্যালোচনা করে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা, ৭. অর্থদাতাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া এবং ৮. ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস/প্রাইভেটকার স্ট্যান্ডগুলোতে নজরদারি করা।

এসব নির্দেশনা প্রতিপালনের অগ্রগতিও জানাতে বলা হয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে। এজন্য তৈরি করে দেওয়া হয়েছে একটি ছক। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার গ্রেপ্তারের সংখ্যা, চেকপোস্টের সংখ্যা এবং তল্লাশির মাধ্যমে আটককৃত সন্দেহভাজক ব্যক্তিদের সংখ্যা। এই ছকটি পূরণ করে সকাল ৬টার মধ্যে তা জানাতে বলা হয়েছে।

হঠাৎ করে কী কেন এই নির্দেশনা জারি করতে হলো- প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে রাজি হননি পুলিশের দায়িত্বশীল কোনও কর্মকর্তা।

তবে ঢাকা বিভাগীয় জোনের একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য সান ২৪কে জানিয়েছেন, ঈদের পর আন্দোলনের নামে নানা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা তারা করছেন। এজন্য পুলিশকে আগাম সতর্ক করে রাখা হয়েছে, যাতে কেউ অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময় গোপনে মিছিল করেছে। এভাবে যেকোনো সময় বড় জমায়েত তারা করতে পারে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। সেসব প্রতিহত করতেই পুলিশের এই বাড়তি সতর্কতা।

পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পাঠানো জরুরি নির্দেশনা।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দৃশ্যত ‘উধাও’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দলটির অন্য নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে আছেন।

এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের এই বাড়তি সতর্কতা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বলে মনে করেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খাইরুল আনাম চৌধুরী (সেলিম চেয়ারম্যান) বলেন, “আমরা এমনিতে আত্মগোপনে আছি। হামলা-মামলায় জর্জরিত। বাইরে বের হতে পারিনি। প্রত্যেকের ঘাড়ে মামলা, হামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়। আমাদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ এসব বলছে।”

“আওয়ামী লীগ কোনো গোপন দল নয়। প্রকাশ্যে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। যখন সময় হবে, সভাপতি ঘোষণা দেবেন, তখনও আমরা সবাই মাঠে নামবো।”

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ঝলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনাম ইয়াকুব বলেন, “আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন পরিবার নিয়ে। মামলা-হামলার ভয়ে অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা কীভাবে ঢাকায় গিয়ে আন্দোলন করবে?”

পুলিশকে গ্রেপ্তার বাণিজ্য করার জন্য এই জরুরি বার্তা বলে মনে করেন তিনি।

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক মিলন বলেন, “এমনিতে আমার অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। অসুস্থ মাকে রেখে দূরে ঈদ করেছি, এটা হয়তো ঈদ বলা যাবে না। এরমধ্যেও পুলিশ সব সময় আওয়ামী লীগের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে। এই নির্দেশনা তারই অংশ।”

বগুড়ার একটি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেন, “এখন সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। সেজন্য তারা প্রকাশ্যে এলেই বিভিন্ন দলের কর্মীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এর সঙ্গে রয়েছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। এই প্রতিকূল পরিবেশে তাদের প্রকাশ্যে আসার সুযোগ খুব বেশি নেই।”

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের বক্তব্য জানতে দ্য সান ২৪ যোগাযোগ করেছে দলটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম আমিনের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “এটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। ৫ আগস্টের পর থেকেই তো বর্তমান অবৈধ সরকার আমাদের দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার মিশনে আছে। অভিযান বলুন বা আক্রোশ বলুন, এটি তারই বর্ধিত সংস্করণ। তবে তাদের এটাও মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ কোনও হাওয়াই দল নয় যে দমনপীড়নে হারিয়ে যাবে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল, এর বিনাশ কোনো ফ্যাসিস্টের ইশারায় হওয়ার নয়।”

পুলিশের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেন বর্তমানে আত্মগোপনে থাকা এই নেতা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads