উপদেষ্টার হুমকিতে পুলিশের ‘ঘুম হারাম’

poilce

স্বরাষ্ট্র ‍উপদেষ্টার কাছ থেকে হুমকির পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকদের গ্রেপ্তারে ‘আদাজল’ খেয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের সংখ্যা বাড়াতে পুলিশের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, কে আওয়ামী লীগের নেতা আর কে সাধারণ নাগরিক সেটিও ধর্তব্যে আনছে না পুলিশ; সব মনোযোগ ‘সংখ্যার’ দিকে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, তাহলে মিছিল করলে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে- প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির কর্মকর্তা বলছেন, “সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা দিলে বা যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মিছিল করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।”

প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠন রাস্তা অবরোধ করে মিছিল-মিটিং করছে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের উত্তর নেই পুলিশের কাছে।

আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের বিরুদ্ধে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হুমিকে বিশ্লেষকেরা দেখেছেন আইনের লঙ্ঘন হিসেবে।

দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের মিছিল

রোববার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে খুলনার জিরো পয়েন্ট এলাকায় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, খুলনা জেলা শাখা’র ব্যানারে মিছিল করেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। সকালের ওই মিছিলের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

এতে দেখা যায়, একদল লোক ব্যানার নিয়ে জিরো পয়েন্ট এলাকায় বিক্ষোভ করছেন। ব্যানারে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি আছে। এ সময় ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার’, ‘শেখ হাসিনা ফিরবে আবার বীরের বেশে’ প্রভৃতি স্লোগান দেওয়া হয়।

এর আগে শুক্রবার রাজধানীর উত্তরায় ঢাকা-১৮ সংসদীয় এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজধানী ঢাকায় ফের মিছিল করেন।

আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তাদের বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বলেন- ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘শেখ হাসিনা আসবে, বাংলাদেশ হাসবে’, ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’,‘শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকে।

এ মিছিলের নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর উত্তর উত্তরখান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান মিলন।

আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল বের করার ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অর্ধশত ঝটিকা মিছিল হয়েছে। সারা দেশে জেলা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল বের করছে। এসব মিছিলে ফটোসেশন করা হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মী সোশ্যাল মিডিয়ায় ছদ্মনামের আইডিতে সেগুলো পোস্ট করছেন। মিছিলের ভিডিও ফুটেজ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের বাইরে পলাতক থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হুমকি

এদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হলেও দলটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের কর্মীরা যাতে কোনো অবস্থায় মিছিল করতে না পারে সেজন্য কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ও ঝটিকা মিছিলের বিরুদ্ধে পুলিশের কোনো নিষ্ক্রিয়তা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ভবিষ্যতে যাতে মিছিল না হতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা কন্ট্রোল না করতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সারাদেশে পুলিশের ধরপাকড়

তবে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য দেওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে কঠোর অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এরপর সারাদেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ধরতে রীতিমত ‘আদাজল’ খেয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ।

গত ১৬ এপ্রিল দিনাজপুর থেকে গাইবান্ধা-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ সারওয়ার কবিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ৬ এপ্রিল রাজধানীর মহাখালী থেকে রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলীকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গত ১৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদকে ডিবি গ্রেপ্তার করে। এর পর দিন ১৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী যুবলীগের ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি মো. আরিফ হোসেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. শাখাওয়াত, নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সহ-সভাপতি বাপ্পি রায়হান, ঢাকা মহানগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. শাহাবুদ্দিন ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের ভাতিজা এবং মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

শনিবার রাজধানীতে যাত্রাবাড়ী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন হোসেন ফাহিমসহ ছাত্রলীগের ছয় জন নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অপর গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—৫৯ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সহসভাপতি শেখ মো. সোহেল, বাড্ডা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক মো. সোহেল রানা, বাড্ডা থানার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়ামিন, ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল বাশার খান ও পল্লবী থানা ছাত্রলীগের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জ্যেষ্ঠ সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম নাইম। এর পাশাপাশি ঢাকার বাইরে সারা দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের অর্ধশত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

রোববার রাজাধানীতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে রোববার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সাব্বির আহমদ নির্ঝর (২৮), মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের পরিবেশ বিষয়ক উপ-সম্পাদক কামরুল আহসান নিশাদ (২৮), শাহবাগ থানার ২০ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল ওরফে কালু (২৫), ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিল হোসেন ওরফে জীবন (৩০), মোহাম্মদপুর থানার ২৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ওহিদ এম আর রহমান (৫০), আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি শামীম শাহরিয়ার (৫৮), ডেমরা থানার পাইটি ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন (৬৪), ৩৩ নং বংশাল ইউনিট যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন মাছুম (৫৮), ঢাকা মহানগর উত্তর ২৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল হাসান রতন (৩৪) এবং উত্তর বাড্ডা এলাকার ছাত্রলীগ কর্মী রবিন দেওয়ান (২৯)।

চট্টগ্রামে ১৮ দিনে গ্রেপ্তার ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গত ১৩ এপ্রিল ৩১ জন, ১২ এপ্রিল ৪৫ জন, ১১ এপ্রিল ২৮ জন, ৮ এপ্রিল ২৯ জন, ৭ এপ্রিল ৩৯ জন, ৬ এপ্রিল ৪৪ জন, ৩ এপ্রিল ৩৯ জন, ২ এপ্রিল ২৯ জন ও ১ এপ্রিল ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা রহিম উদ্দীন খান ও তার ছেলে রবিন খানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার শোমসপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

শনিবার রাজশাহী মহানগর পুলিশ রাজশাহীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাহাবুল ইসলাম কমল ও রাজশাহী মহানগর তাঁতী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকশেদউল আলম সুমনকে গ্রেপ্তার করে।

শনিবার ভোরে উপজেলার ভবানীগঞ্জ বাজার থেকে জুড়ী উপজেলা থেকে যুবলীগ নেতা মাসুক মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে জুড়ী থানা পুলিশ। মাসুক জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের পশ্চিম ভবানীপুর গ্রামের সামসু মিয়ার ছেলে। ঝিনাইদহে গত ১৫ দিনে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া বরিশাল, যশোর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও খুলনায় বিভিন্ন সময়ে মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ। এসব ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েক জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে।

বাড়ি বাড়ি পুলিশের অভিযান

এদিকে যশোরে আত্মগোপনে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারসহ শীর্ষ নেতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে।

রোববার দুপুরে গাড়ির বহরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়ে এমন অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কাউকে আটক বা কিছু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা জানান, সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা ঝটিকা মিছিল করছেন। ঝটিকা মিছিল বন্ধ করতে না পারলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এরই অংশ হিসেবে নেতা–কর্মীদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পুলিশের এ অভিযান চালানো হচ্ছে।

গ্রেপ্তার নিয়ে পুলিশের সাফাই

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মো. তালেবুর রহমান জানান

আওয়ামী লীগ মিছিল করলে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, “পুলিশের অ্যাক্ট অনুযায়ী কেউ সমাবেশ করতে চাইলে পূর্বানুমতি নিতে হবে। অনুমতি না নিলে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা হবে। সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা দিলে বা যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মিছিল করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।”

বিশ্লেষকেরা যা বলছেন

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, আওয়ামী লীগ মিছিল করলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশকে তিনি নির্দেশ দিলেন- আওয়ামী লীগ যাতে মিছিল করতে না পারে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই নির্দেশ দিলেন কোন আইনে?”

তিনি আরও বলেন, “যে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেনি, অথচ সেই সরকারের উপদেষ্টা পুলিশকে তাদের কর্মসূচি বন্ধ করতে নির্দেশ দিচ্ছে। পুলিশ কোন আইনে মিছিল বন্ধ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার করবে? তাহলে পুলিশকে বেআইনি কর্মকাণ্ড করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা? অথচ কিছুদিন আগে এই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন- আমি বেআইনি নির্দেশ দিলেও আপনারা মানবেন না।”

আরও পড়ুন