স্পেন, পর্তুগাল ও দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের কিছু অঞ্চলে সোমবার বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। এতে মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং লিসবনের মতো বড় শহরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
বিভ্রাটের ফলে কয়েক লাখ মানুষ সমস্যায় পড়েন। বাসাবাড়ি, অফিস, ট্রেন চলাচল, ট্রাফিক সিগন্যাল, এমনকি মাদ্রিদ ওপেন টেনিস টুর্নামেন্ট পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সারা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্পেন ও পর্তুগালের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্ক অপারেটররা দ্রুত সমস্যা খুঁজে বের করে সমাধান করতে উদ্যোগী হন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে স্পেন ও পর্তুগাল সরকার জরুরি অবস্থা জারি করেছে। স্পেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্দালুসিয়া, এক্সত্রেমাদুরা, মুরসিয়া, লা রিওহা এবং মাদ্রিদ অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টেনেগ্রো রাতের শেষ দিকে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক শেষে দেশটিতে বিদ্যুৎ সংকট ঘোষণা করেছেন। দেশটির বিদ্যুৎ গ্রিড অপারেটর সতর্ক করে বলেছে, পুরোপুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধার করা একটি “জটিল প্রক্রিয়া” হবে।
সোমবারের শেষ নাগাদ গ্রিড অপারেটররা জানায়, উভয় দেশের কিছু কিছু এলাকায় ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ভোর নাগাদ স্পেনে ৮৭ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত সব সাবস্টেশন আবার কাজ করছে। অন্যদিকে পর্তুগালে বিদ্যুৎ ফিরে পাওয়ায় রাতে মানুষজন রাস্তায় আনন্দ প্রকাশ করছে—সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
কি ঘটেছিল
স্পেনের বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান রেড ইলেকট্রিকা ডি এসপানা (আরইই) জানায়, স্পেন ও পর্তুগাল “এল সেরো” বা “শূন্য স্তর” নামক একটি বিদ্যুৎ বিভ্রাটে আক্রান্ত হয়। পর্তুগালের সমমানের প্রতিষ্ঠান রিডস এনার্জিটিকাস ন্যাসিওনাইস (আরইএন) জানায়, স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ৩৩ মিনিটে বিভ্রাট শুরু হয়।
দুপুরের পর আরইই জানায়, তারা ইতোমধ্যে আইবেরীয় উপদ্বীপের উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চলে ধাপে ধাপে ভোল্টেজ পুনরুদ্ধার শুরু করেছে। তবে পুরো নেটওয়ার্কে একসঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলে অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে। তাই ধাপে ধাপে সংযোগ পুনরুদ্ধার করা হয়।
স্পেনের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এনডেসা। এর গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি। আর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান ইবেরড্রোলা। এনডেসা ও ইবেরড্রোলা সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজ করছে। এক্ষেত্রে তারা নিয়মিত প্রটোকল মেনে ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে।

বিভ্রাটের কারণ কী
পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী লুইস মন্টেনেগ্রো জানান, সমস্যার উৎস স্পেনে। আরইএন জানায়, একটি “দুর্লভ বায়ুমণ্ডলীয় প্রাকৃতিক ঘটনার” কারণে তাপমাত্রায় তীব্র তারতম্য ঘটে। আর একেই এই বৃহৎ বিভ্রাটের কারণ হিসেবে বলছে আরইএন।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, “স্পেনের অভ্যন্তরীণ এলাকায় তাপমাত্রার চরম তারতম্যের কারণে ৪০০ কেভি উচ্চ ভোল্টেজ লাইনে অস্বাভাবিক কম্পন সৃষ্টি হয়। একে ‘ইনক্লুডেড অ্যাটমোসফেরিক ভাইব্রেশন’ বলা হয়। এই কম্পনের ফলে ইউরোপীয় বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থায় সমন্বয় ব্যাহত হয় এবং একের পর এক বিভ্রাট ঘটতে থাকে।”
বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর তাপমাত্রার বড় তারতম্যের প্রভাব বিদ্যুৎ খাতে বহুদিন ধরে পরিচিত। যদিও এতো বড় মাত্রায় সমস্যা এর আগে দেখা যায়নি।
বিদ্যুৎ ইউটিলিটি সফটওয়্যার কোম্পানি ‘নেয়ারা’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক টাকো ইংগেলার বলেন, “তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে বৈদ্যুতিক তারের গঠন ও গুণাগুণ সামান্য বদলে যায়। এর ফলে সিস্টেমের ফ্রিকোয়েন্সিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।”
ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুগেলের জ্যেষ্ঠ গবেষক জর্জ জাখমান জানান, “বিদ্যুৎ গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি ইউরোপীয় মান ৫০ হার্জের নিচে নেমে গেলে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ফ্রান্সের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও ছিল।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাইবার নিরাপত্তা শাখা ধারণা করছে, স্পেন, ফ্রান্স ও পর্তুগালের কিছু অংশে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পেছনে কোনও প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা কেবল সংক্রান্ত সমস্যা দায়ী হতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর সাইবারসিকিউরিটির (ইনিসা) প্রাথমিক তদন্তে সাইবার হামলার সম্ভাবনা কম দেখা গেছে। একজন মুখপাত্র বলেছেন, “বর্তমান তথ্য-প্রমাণে মনে হচ্ছে এটি কোনও প্রযুক্তিগত বা কেবল সংক্রান্ত সমস্যা।”
ইনিসা জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং জাতীয় ও ইইউ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে।
স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক সরকারের প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল মোরেনো বলেছেন, “সমস্ত লক্ষণই বলছে যে, এমন একটি বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা শুধুমাত্র একটি সাইবার আক্রমণের কারণেই হতে পারে।”
স্প্যানিশ কর্মকর্তারা প্রথমে জানিয়েছিলেন যে তারা এই ব্যাপক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার কারণ হিসেবে সাইবার আক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। সরকারের এক সূত্র পলিটিকোকে জানিয়েছে, “সাইবার আক্রমণের সম্ভাবনা এখনও খারিজ করা হয়নি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।”
বিদ্যুৎ গ্রিড অবকাঠামোর উপর অতীতের সাইবার হামলাগুলো লক্ষাধিক মানুষকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মুখে ফেলার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রুশ হ্যাকাররা ইউক্রেনের তিনটি জ্বালানি সংস্থার সিস্টেম বিকল করে দেয়। এর ফলে ২ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়।
ধারণা করা হয়, এই হামলাগুলো রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে স্যান্ডওয়ার্ম হ্যাকিং গ্রুপের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল
গোয়েন্দা প্রধানরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, শত্রু রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেনের বিদ্যুৎ গ্রিড এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অবকাঠামোকে লক্ষ্য করছে।
এপ্রিলের শুরুতে যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী পিটার কাইল দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছিলেন, দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্রিফিং তাকে “আমাদের দেশ ও গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোকে নিরাপদে রাখার সক্ষমতা নিয়ে গভীর উদ্বেগে” ফেলেছে।
কাইল বলেন, “আমি সত্যিই বেশ হতবাক হয়েছিলাম, যখন দেখলাম কিছু দুর্বলতা সম্পর্কে আমরা জানতাম, কিন্তু তারপরও কিছুই করা হয়নি।”

এটি কি নাশকতা ছিল
ইউরোপীয় কাউন্সিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা। তিনি ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, এই বিভ্রাটের পেছনে কোনও সাইবার হামলার প্রমাণ মেলেনি। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, চূড়ান্ত কারণ এখনও স্পষ্ট নয়।
ইউরোপীয় কমিশনের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি তেরেসা রিবেরা স্পেনের রেডিও ৫-কে জানান, এই বিভ্রাট কোনও ইচ্ছাকৃত কাজের ফল বলার মতো কোনও প্রমাণ নেই।
তবে স্পেনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সোমবার জরুরি বৈঠকে বসে বিভ্রাটটি মূল্যায়ন করেছে। পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কী কারণে এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেছে।
নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা কী
স্পেন এখন সবুজ জ্বালানিতে বিশ্বে অগ্রগামী হওয়ার পথে। দেশটিতে সূর্যের তাপ ও বাতাস পর্যাপ্ত। গত বছর স্পেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে রেকর্ড অর্জন করে। দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৫৬ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সরবরাহ হয়। ২০২৩ সালের মধ্যে এই অনুপাত ৮১ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পরিবর্তন স্পেনকে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে। তবে এর সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জও আসছে। প্রতিটি দেশের জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দরকার, যাতে বিচ্ছিন্নভাবে উৎপাদিত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সংযুক্ত করে সঠিকভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
গ্রিড ব্যালেন্সিং কী
বিদ্যুৎ গ্রিডকে সবসময় এমনভাবে পরিচালনা করতে হয়, যাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে তা চাপের মুখে না পড়ে অথবা উৎপাদন কম হলে ঘাটতি না হয়। গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি স্বাভাবিক সীমার বাইরে চলে গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেগুলো পুনরায় চালু করতে হলে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপন করতে হয়।
গ্রিড ব্যালেন্সিং বহুদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এখন এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। কারণ নবায়নযোগ্য উৎস যেমন সৌর ও বায়ু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে। এগুলো প্রকৃতিনির্ভর এবং সবসময় একই রকম বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না।
দীর্ঘদিন ধরে গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণে ঘূর্ণায়মান গ্যাস টারবাইন ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এখন নতুন প্রযুক্তি যেমন ফ্লাইহুইল বা উন্নত পাওয়ার ইলেকট্রনিকসেও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
ব্রুগেলের গবেষক জাখমান বলেন, “আপনি এই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। সিস্টেম চালু রাখতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আপনার থাকতে হবে।”
আন্তর্জাতিক সংযোগ কি সমস্যা তৈরি করেছে
নেয়ারার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইংগেলার বলেন, এত বড় পরিসরে ব্যর্থতা অত্যন্ত বিরল। তবে অতীতে এর উদাহরণ রয়েছে। ২০০৩ সালে ইতালি ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে জলবিদ্যুৎ লাইনে সমস্যা দেখা দিলে পুরো ইতালিতে প্রায় ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। আবার ২০০৬ সালে জার্মানিতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপের কারণে পর্তুগাল ও মরক্কো পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছড়িয়ে পড়ে।
ইংগেলার বলেন, “বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পরিবেশবান্ধব এনার্জি ভাগাভাগি করতে সহায়তা করে। তবে একই সঙ্গে এই সংযোগ বিপর্যয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পথও তৈরি করে।”
তবে গবেষক জাখমান বলেন, আন্তঃসংযোগ অনেক সময় সমস্যা কমাতেও সহায়ক হয়। ফ্রান্সের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকার ফলে স্পেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, “হ্যাঁ, সমস্যা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে একই সঙ্গে বৃহৎ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা একটি বাফার হিসেবে কাজ করে এবং সঙ্কট আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠা প্রতিরোধ করে।”
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, পলিটিকো, বিবিসি, সিএনএন, দ্য টেলিগ্রাফ, ব্রুগেল।