রাষ্ট্রপতি একজন আছেন দেশে, কিন্তু আদৌ আছেন তো? জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
গত বছরের অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দেখা কালেভদ্রেও মিলছে না। তবে তার ছবি ঝুলছিল বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে। হঠাৎ করে সেই ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশেই রাষ্ট্রপতির ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে বলে দূতাবাস কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন। তবে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তা নিয়ে চুপ।
শুধু একজন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেছেন, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর বিষয়ে লিখিত কোনও নির্দেশনার কথা তার জানা নেই। এনিয়ে উপদেষ্টা পরিষদেও কোনো আলোচনা হয়নি।
তাহলে এখন রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর প্রয়োজন কেন পড়ল কিংবা এর উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে সারাদেশেই চলছে গুঞ্জন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০২৩ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন দুদকের সাবেক কমিশনার সাহাবুদ্দিন। পাঁচ বছরের মেয়াদ হিসেব করলে ২০২৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তার এই পদে থাকার কথা।
তবে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। বলতে গেলে, পদে থাকলেও সবচেয়ে বেশি চাপে আছেন তিনি।
ইউনূসসহ অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের শপথ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শাহাবুদ্দিন পড়ালেও তার পরপরই তাকে অপসারণের দাবি তুলেছিল অভ্যুত্থানের পক্ষের বিভিন্ন গোষ্ঠী।
তবে সাংবিধানিক সঙ্কটের কথা তুলে বিএনপি বেঁকে বসায় রাষ্ট্রপতি পদে শাহাবুদ্দিন টিকে গেলেও তিনি যে গুরুত্বহীন, তা অন্তর্বর্তী সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে স্পষ্ট।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বিভিন্ন দেশ সফর থেকে ফিরলেও রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন না। জাতীয় দিবসগুলোতেও রাষ্ট্রপতির কর্মকাণ্ডের খবর সরকারি প্রচার মাধ্যমে আসছে না।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা বাসসে আগে জাতীয় খবরে সবচেয়ে ওপরের সেকশনটি ছিল রাষ্ট্রপতির জন্য। এখন সেখানে সবার ওপরে ‘প্রধান উপদেষ্টার সংবাদ’, তারপর ‘জাতীয় সংবাদ’, ‘শীর্ষ সংবাদ’ এর পরে ‘রাষ্ট্রপতি’ নামে সেকশনটি এখন রয়েছে। সেখানে এখন মাত্র তিনটি সংবাদ ঝুলছে, তাও গত জানুয়ারির। অর্থাৎ গত ২৯ জানুয়ারির পর বাসসও রাষ্ট্রপতির কোনো সংবাদ দেয়নি।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে শাহাবুদ্দিন এমন চরম অবহেলায় থাকার মধ্যে রোববার খবর আসে, বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস থেকে তার ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা এনিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাতে কয়েকটি দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছেন।
লন্ডন হাইকমিশন সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা পাওয়ার পর লন্ডন হাইকমিশনে থাকা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের ছবি শুক্রবার রাতেই সরিয়ে ফেলা হয়।
ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত পাঁচটি দূতাবাস কর্মকর্তারাও ঢাকা থেকে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়ার কথা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।
একটি দূতাবাসের কর্মকর্তা বলেন, “হেডকোয়ার্টার (ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) শুধু বলেছে, তোমাদের দূতাবাসসহ অন্য যদি কোনো দূতাবাসে রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে, সেটি সরিয়ে ফেল।”
কেউ কেউ আবার সেই নির্দেশনা না পেলেও খবরটি শুনেই ছবি নামিয়ে ফেলেছেন।
এনিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য জানতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিবিসি বাংলা। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।
সংবাদমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সোশাল মিডিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে; যদিও রাষ্ট্রপতি অপসারিত হলে তার শূন্য স্থান পূরণের জন্য স্পিকারও এখন পদে নেই।
এমন গুঞ্জনের মধ্যে রবিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে পেয়ে তাকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে তিনি বলেন, বিদেশের মিশনগুলো থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।
তবে এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই, একথাও যোগ করেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা এরই মধ্যে দিয়েছেন ইউনূস।
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, গত ১১ অগাস্ট সরকারি সফরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গিয়েছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি টানানো দেখে উষ্মাও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিষয়টি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবেন।
সুইজারল্যান্ড সফর শেষে শনিবার দেশে ফেরেন রিজওয়ানা। তার পরপরই দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রপতির ছবি নামানোর নির্দেশ যায়।
তবে রিজওয়ানা বিবিসি বাংলার প্রশ্নে বলেন, জেনেভা দূতাবাসে তিনি রাষ্ট্রপতির কোনো ছবি দেখেননি এবং এনিয়ে তার সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কথাও হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ অনুচ্ছেদে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখা কার্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ব্যবহারের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধুর নাম এখন সরকারি দপ্তরে নির্বাসনে। বঙ্গভবন থেকে তার ছবি নামিয়ে ফেলেছিলেন স্বয়ং তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, যাকে এই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা হয়।
সরকারি দপ্তরে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের ছবি ব্যবহার করা নিয়ে কোনো আইন, বিধি বা সাংবিধানিক নির্দেশনা নেই।
তবে ২০০২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রীদের কার্যালয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি কিংবা ছবি টানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই নির্দেশ অনুযায়ী সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার হয়ে আসছিল। গত বছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সরকারি দপ্তরগুলো থেকে তার ছবি নামিয়ে ফেলা হয়।
কোনো ধরনের নির্দেশনা না থাকার পরও রাষ্ট্রপতির ছবি বিভিন্ন দূতাবাস কার্যালয়ে কেন ব্যবহার করা হয়ে আসছিল?
তার উত্তরে আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রত্যেকটা দেশে রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনার যারা থাকেন, সেখানে তাদের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি থাকে, এটা একটা কাস্টম। এটা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। সেই হিসেবেই হয়ত রাষ্ট্রপতির ছবি ছিল।”
তবে সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে সরকারি আদেশেই রাষ্ট্রপতির ছবি ব্যবহার করা হত দূতাবাসগুলোতে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কার ছবি কোথায় টানাতে হবে, সেই নির্দেশ কেবিনেট থেকে এটি ইস্যু করা হয়।”
রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর বিষয়ে সরকারের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য না থাকার সমালোচনা করে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাষ্ট্রপতির ছবি রাখার কোনো আইন ছিল না। তারপরও যদি কোনো অফিসে সেটা ব্যবহার করে থাকে এই সরকারের সময়, তাহলে সরকারের উচিৎ ছিল লুকোচুরি না করে লিখিতভাবে নির্দেশনা জারি করা।”