একই দিনে দুটি ভিন্ন সংবাদ নিয়ে পিছু হটতে হল বাংলাদেশের প্রভাবশালী দুটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ও দি ডেইলি স্টারকে।
প্রথম আলোর সংবাদটি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির দুই নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে নিয়ে।
এনিয়ে হাসনাতের আক্রমণাত্মক ফেইসবুক পোস্টের পর প্রথম আলো রোববার সংবাদটির শিরোনাম ও প্রতিবেদনের কিছু অংশ পরিবর্তন করে।
অন্যদিকে ডেইলি স্টারের সংবাদটি ছিল দিনাজপুরের হিন্দু ধর্মীয় নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় খুন হওয়াকে নিয়ে। এই হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের নজির হিসাবে দেখিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ভারত সরকার।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার রবিবার ভারতের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়ার পর ডেইলি স্টার সেই সংবাদ প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলে। তাদের সংবাদ সরিয়ে ফেলার ব্যাখ্যাটি আবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ফেইসবুক পেইজে শেয়ারও দিয়েছেন।
একই ঘরানার সংবাদপত্রে দুটির এই দুটি ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আবার প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
প্রবাসী কলামিস্ট মারুফ মল্লিক লিখেছেন, “দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর এক মিডিয়া কন্ট্রোল চলছে।”
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মুক্ত মত চর্চায় বাধা ছিল বরাবরই আলোচনার বিষয়বস্তু।
গত বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের মে মাসে আর্টিকেল নাইনটিনের সূচকে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বে ১২৮তম ছিল বাংলাদেশ। স্কোর ছিল মাত্র ১২। যেখানে ২০০০ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪৪।
তার তিন মাসের মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা উঠে যাবে বলেই আশা করা হচ্ছিল।
তবে এই আশার গুঁড়ে বালি পড়ে যখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দখলের পালা শুরু হয়। তাতে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যায়িত করে বিভিন্ন সাংবাদিককে কালো তালিকাভুক্ত করাও চলতে থাকে।
তারপরও গত অক্টোবরে ভয়েস অব আমেরিকার চালানো এক জনমত জরিপে দেখা গিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সংবাদমাধ্যম আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে ৬১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ মনে করেন।
হাসনাতের আক্রমণে সংশোধনী?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সময় টিভির কয়েকজন সাংবাদিককে ছাঁটাইয়ে চাপ দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছিল।
সমালোচনার মুখে অবশ্য হাসনাত তখন ওই সাংবাদিকদের পুনর্বহালের অনুরোধ জানিয়ে ঘটনাটির সেখানেই শেষ করেছিলেন।
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা হাসনাত তাদের গড়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠক হওয়ার পর শনিবার প্রথম আলোতে তাকে নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।
এনসিপির শুক্রবারের এক সভায় আলোচনার বিষয়বস্তু ধরে প্রথম আলো শনিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল- ‘সারজিস-হাসনাতের বিলাসী জীবন নিয়ে এনসিপিতে প্রশ্ন’।
ওই সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হলে হাসনাত শনিবার রাতে ফেইসবুকে একটি পোস্টে প্রথম আলোকে আক্রমণ করেন।
তিনি লেখেন, “দিল্লী থেকে লিখে দেওয়া নিউজ করে যদি ভেবে থাকেন হাসনাত আব্দুল্লাহকে থামাতে পারবেন, তাহলে আপনারা এখনও ভুলের জগতে আছেন।
“থামার হলে আপনাদের মতোই ভারত বা র এদের তাঁবেদারি করে মন্ত্রী হওয়ার হিসাব করতাম। বিলাসিতাই যদি করতে চাইতাম, তাহলে আমার এত যুদ্ধ করার দরকার ছিল না আপনাদের সাথে মিলে মিশেই বিলাসি জীবন বেছে নিতে পারতাম। আমি সেটা করিনি এবং করবও না “
“যতই তথ্যসন্ত্রাস করেন, আমি ভারত আর র এর বিরুদ্ধে কথা বলা থামাবো না, আওয়ামী লীগ ফেরানোর কোন উদ্যোগ জীবন থাকতে সফল হতে দেব না,” প্রথম আলোর উদ্দেশে লেখেন তিনি।
হাসনাত আরও অভিযোগ করেন, “প্রথম আলো বারবারই এ দেশের সৎ এবং দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে বা যারাই দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, তাদেরকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। আমি সেই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন।”
তার ওই ফেইসবুক পোস্টের পর প্রথম আলো রবিবার তাদের অনলাইন সংস্কররণে প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম পরিবর্তন করে। তাতে এখন শিরোনাম দাঁড়িয়েছে- ‘এনসিপির সাধারণ সভা: নানা প্রশ্ন ও অভিযোগের জবাব দিলেন নেতারা’।
প্রতিবেদনের ভেতরেও কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের নিচে সংশোধনী দিয়ে প্রথম আলো লিখেছে- “এই প্রতিবেদনের প্রথম প্রকাশিত শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভেতরের অংশবিশেষও পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের পরে আরও কিছু তথ্য জানার পর এই পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা হল।”
এই পরিবর্তনের কারণ অবশ্য প্রথম আলো প্রকাশ করেনি। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের কারও বক্তব্যও কোথাও পাওয়া যায়নি।
সংবাদ প্রত্যাহার ডেইলি স্টারের
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার গত ১৮ এপ্রিল দিনাজপুরে ভবেশ চন্দ্র রায় খুন হওয়ার সংবাদটি প্রকাশ করেছিল। তার শিরোনাম ছিল- ‘দিনাজপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকে অপহরণের পর পিটিয়ে হত্যা’।
ডেইলি স্টারের সেই প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবরটি এসেছিল। বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ভারতে আগে থেকে বাদ-প্রতিবাদ চলছে।
ভবেশের মৃত্যু নিয়ে শনিবার প্রতিক্রিয়া আসে ভারত সরকার থেকে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড একটি ধারাবাহিক নিপীড়নের অংশ, যেখানে হিন্দু সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হচ্ছে এবং পূর্বের ঘটনাগুলোর অপরাধীরা বিনা শাস্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
তার সেই বক্তব্যের প্রতিবাদ রবিবার জানান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসকে বলেন, “আমরা এই ভিত্তিহীন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করছি।
“বাংলাদেশ এমন দেশ নয়, যেখানে সংখ্যালঘুরা সরকারের সমর্থনে কোনও বৈষম্যের শিকার হন। বাংলাদেশ সরকার সব নাগরিককে তার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে অধিকার রক্ষা করে।”
ভবেশের ওপর হামলা নিয়ে শফিকুল বলেন, “এই নির্দিষ্ট ঘটনায়, আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ভুক্তভোগী পূর্বপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলেন। তার পরিবার কারও সঙ্গে বাইরে যাওয়া নিয়ে সন্দেহজনক কিছু জানাননি।”
প্রেস সচিবের বক্তব্যের পর রবিবারই ডেইলি স্টার তাদের অনলাইন সংস্করণ থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেয়।
সেই ঘোষণা দিয়ে একটি বক্তব্যও প্রকাশ করেছে ডেইলি স্টার। সেখানে বলা হয়েছে- “প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর আমরা পুলিশ ও অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার প্রতিবেদন দেখে আমাদের প্রতিবেদনে ব্যবহৃত উৎসগুলো পুনরায় পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।

“যদিও ভবেশ চন্দ্র রায়ের পরিবারের সদস্যরা তার মৃত্যুকে ঘিরে সন্দেহজনক পরিস্থিতির অভিযোগ করেছেন, তবে তার সমর্থনে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ আমাদের প্রতিবেদনে ছিল না। আমাদের অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার সময় আমরা জানতে পেরেছি যে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর প্রকাশ করা হয়েছিল। এর ফলে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এটি প্রকাশের ক্ষেত্রে দি ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় মান, বিশেষ করে তথ্য যাচাই এবং উৎস নিশ্চিত করার শর্তে ঘাটতি ছিল। তাই আমরা ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
কোনো ধরনের চাপের কথা অবশ্য ডেইলি স্টারের বক্তব্যে আসেনি।
পরিস্থিতি আসলে কী?
অভ্যুত্থানের পর নানা ধরনের চাপ মোকাবেলার কথা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বলছেন; যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কোনো ধরনের চাপ দেওয়ার কথা স্বীকার করছেন না।
বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের বার্তা কক্ষ ব্যবস্থাপনায় থাকা একাধিক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য সান ২৪ কে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে একটি জায়গা থেকে চাপ সামলাতে হত তাদের। এখন বিভিন্নমুখী চাপ মোকাবেলা করে তাদের চলতে হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিক থেকে প্রকাশ্য চাপের পাশাপাশি সরকারের তরফে অপ্রকাশ্য চাপও জারি রয়েছে বলে জানান তারা।
এদের একজন বলেন, “আপনি দেখবেন, শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো বক্তব্য-বিবৃতি কেউ ছাপছে না। কেন এটা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন করুন। শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে তো তা নেই। তাহলে কেন সংবাদের গুরুত্ব থাকলেও সেগুলো ছাপা হচ্ছে না?
“শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের সাধারণ বক্তব্য প্রকাশেরর পর তা সরিয়ে নেওয়ার চাপ এসেছে সরকার থেকে। সেজন্য এখন কেউ আর তা প্রকাশের ঝুঁকি নিতে সাহস করছে না।”
তবে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, যিনি কয়েক মাস আগেও তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি দাবি করছেন, বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ রয়েছে এবং যে যার মত প্রকাশ করতে পারছে।
রবিবার খেলাফত মজলিসের নেতাদের সঙ্গে এনসিপির নেতাদের বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এই দাবি করেন।
নাহিদ যখন তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন, তখনই বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হয়। আওয়ামী লীগ আমলে প্রণীত এই আইনটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করে বলে সমালোচনা ছিল ব্যাপক।
অন্তর্বর্তী সরকার আইনের নাম বদলে সাইবার সুরক্ষা আইন করে যে সব সংশোধনী এনেছে, তাতে মত প্রকাশ রুদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো আগের মতোই থাকছে বলে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
প্রবাসী সাংবাদিক মারুফ মল্লিক রবিবার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “দেশের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর এক মিডিয়া কন্ট্রোল চলছে৷ আগে ছিল প্রশাসন দিয়ে কন্ট্রোল। এখন তো মব, ফেইসবুক মব দিয়ে মিডিয়া কন্ট্রোল করে ফেলে।”
অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল এনসিপি, জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে এখন কোনো ‘নিউজ করা যায় না’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম আলোর কলামিস্ট মারুফ এই পত্রিকাটির সংবাদ সংশোধন নিয়ে লিখেছেন, “প্রথম আলো শিরোনাম করেছিলো-‘বিলাসী জীবন যাপনসহ নানা প্রশ্নের মুখে সারজিস ও হাসনাত”। এখানে সারজিস ও হাসনাতকে নানা প্রশ্ন করা হয়েছে। শুধু বিলাসী জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়নি।
“কিন্তু হাসনাত মনে করলেন তাকেই বিলাসী জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা হইছে। সাথে প্রথাগত স্টাইলে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার গল্প জুড়ে দিলো। চাপ দিয়ে সংবাদ পরিবর্তন করতে বাধ্য করলো।”
“এরকম গল্প ও চাপ আম্লীগ দিত। ভয় দেখাইতো। এখন এনসিপি ভয় দেখায়। গণমাধ্যমের অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। ছাত্র নেতাদের নানা কুকীর্তির কথা লেখা যায় না মবের ভয়ে। এখন গণমাধ্যমে যা দেখেন, তা প্রকৃত অবস্থার ছিটাফোঁটা,” দাবি করেন মারুফ।