দ্য সান ২৪’র বিশ্লেষণ: গোপালগঞ্জের ঘটনায় কার উদ্দেশ্য হাসিল হলো?

গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর অভিযান। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজনকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া।
গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর অভিযান। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজনকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা গোপালগঞ্জ যাওয়ার আগে এক যুগ আগের একটি ভিডিও পুনরায় দেখা গেল ফেইসবুকে। নানাজন শেয়ার করছিলেন খালেদা জিয়ার সেই ভিডিও। যেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন বলছিলেন, গোপালগঞ্জ থাকবে না। 

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচি পালনে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে ক্ষিপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া এক নারী পুলিশকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “দেশ কোথায়? গোপালী? গোপালগঞ্জের নামই বদলে যাবে। গোপালগঞ্জের নামই থাকবে না।”

গোপালগঞ্জ নিয়ে তার সেই ক্ষোভের কারণ ছিল, সেটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেলা। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থল ওই জেলা সব সময়ই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি।

গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যখন শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে, তখনও কয়েকদিন আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থকরা লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে।

সেই অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল এনসিপির পদযাত্রার কর্মসূচি ঘিরে বুধবার রণক্ষেত্রে রূপ নেয় গোপালগঞ্জ। এনসিপির সমাবেশ মঞ্চ ভাংচুরের পর নির্বিচারে গুলি চালায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব। চারজন নিহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে; যদিও স্থানীয়দের দাবি, সংখ্যাটি আরও বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারির পাশাপাশি কারফিউও দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে গোপালগঞ্জের ঘটনা মনিটরিং করছেন সবকিছু মনিটরিং ও নির্দেশনা দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানরা।

কিন্তু প্রশ্ন আসছে, দুদিন আগেও শান্ত থাকা গোপালগঞ্জকে উত্তপ্ত করে কে কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইল? এনসিপি কেন যুদ্ধংদেহি হয়ে ছিল? সেনাবাহিনী সেখানে থেকেও করেছে কী? সরকার কেন দর্শক হয়ে থাকল?

এনসিপির পদযাত্রা গোপালগঞ্জ যাওয়ার আগেই কোনও ষড়যন্ত্রের আঁচ সম্ভবত পেয়েছিলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের। তাই একদিন আগেই ফেইসবুকে এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, “গোপালগঞ্জের উদ্দেশ‍্যে পদযাত্রা করতেছেন, ভালো কথা, কিন্তু এমন কোনো কাণ্ড কইরেন না, যাতে আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণ ঘটে ও আপনাদের বদৌলতে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়। যদি তা ঘটে তাহলে অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক দলটিকে আপনারাই প্রাসঙ্গিক করে ফেলবেন।”

এমন সন্দেহের ভিত্তি দিচ্ছে এনসিপির নেতাদের কার্যক্রম। অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে দলটির কেন্দ্রীয় সব নেতা জুলাই পদযাত্রা শুরু করেছিল গত ১ জুলাই, উত্তরাঞ্চল থেকে। একের পর এক জেলা হয়ে তারা বুধবার গোপালগঞ্জ পৌঁছে। কিন্তু আর কোনো জেলা নিয়ে তাদের এত মাতামাতি ছিল না।

গোপালগঞ্জ যাওয়ার অন্তত দুদিন আগে থেকে তারা সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতে থাকে- “১৬ জুলাই, মার্চ টু গোপালগঞ্জ’। আর কোনো জেলার বেলায় তো এমনটার দেখা যায়নি। পদযাত্রা গোপালগঞ্জে এসে কেন ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হয়ে গেল, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

তারমধ্যে আবার টুঙ্গীপাড়ায় থাকা বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ উপড়ে ফেলার উসকানিও আসতে থাকে ফেইসবুকে। যেভাবে বছরের শুরুতে সোশাল মিডিয়ায় উসকানি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেই সঙ্গে চলে ‘মুজিববাদের কবর রচনা’র বোলচাল।

গোপালগঞ্জ যে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি, তা তো খালেদা জিয়া কেন, দেশের সবারই জানা। গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ঠেকানোর কোনো ঘোষণা কেউ দেয়ওনি। তাহলে কেন গোপালগঞ্জে যাওয়ার আগে উত্তপ্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হলো? এই প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই আসে। 

এনসিপির সমাবেশস্থলে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

এটার উত্তর হতে পারে এমন- গত জুলাইয়ের বিক্রম হারিয়ে ফেলা অভ্যুত্থানের নেতারা এখন তা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গোপালগঞ্জকে আশ্রয় করে আবা্র সারাদেশে জোশ আনতে চাইছিলেন।

কিন্তু পরিস্থিতি তাদের ধারণার বাইরে চলে যায়। ফলে গোপালগঞ্জে গিয়ে সমাবেশ করে যতই ‘বিজয়ী’ হওয়ার গল্প এনসিপির সমর্থকরা দেন না কেন, আদতে পালিয়েই বেঁচে আসতে হয়েছে নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম ও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীদের।

সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানের ভেতরে তাদের ঢোকার দৃশ্যটি আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে অনেকের মনে। এই পদযাত্রায় দুদিন আগে পটুয়াখালীর সমাবেশেই নাহিদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

কয়েকমাস আগে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুলে আলোচনা তৈরি করেছিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ। তাই হয়ত সেনাবাহিনীর এপিসিতে উঠতে চাইছিলেন না তিনি। এপিসি থেকে নেমে সারজিস তাকে ধরে নিয়ে আসছেন, ভিডিও দেখে সবার তাই মনে হবে।

এই ভিডিও শেয়ার করে জুলকারনাইন শায়ের লিখেছেন, “দেশের সাহসী ছেলেদের যেই অশুভ শক্তি গোপালগঞ্জের দিকে ঠেলে দিয়ে আজ সামরিক বাহিনীর এপিসি (আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার) এর নিরাপত্তায় ঘটনাস্থল ত‍্যাগ করতে বাধ‍্য করলো, ওই অশুভ শক্তিকে ধিক্কার।”

যার মানে দাঁড়ায়, একটি টোপ গিলেছিলেন অভ্যুত্থানের তরুণ নেতারা, যারা দল গড়ে রাজনীতির মাঠে ঠাঁই করে নিতে চাইছেন। সেই টোপটি কে দিয়েছিল? কেউ কেউ বলছেন ‘বুলডোজার গ্যাং’ এর কথা।

সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রহরায় সমাবেশস্থলে এনসিপির নেতারা।

অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনী এখনও শক্ত হয়ে দাঁড়াতে না পারলেও সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে। ডিজিএফআইও সক্রিয়। তাহলে গোপালগঞ্জের ঘটনা এড়াতে আগে কেন সতর্ক থাকল না তারা? সেই প্রশ্নও আসে স্বাভাবিকভাবে।

উত্তর হতে পারে এমন- সেনাবাহিনী চাইছিল এনসিপি নেতারা একটু বেকায়দায় পড়ুক। কারণ গত কিছু দিন ধরেই তারা সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়ে আসছে।

যখন এনসিপি নেতারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন, তখন তাদের ত্রাণকর্তা হয়ে উদ্ধার করে সেনাবাহিনী বুঝিয়ে দিল, বিপদে পড়লে আমাদের কাছেই আসতে হবে। অর্থাৎ এখানে অভ্যুত্থানের নেতাদের নৈতিক পরাজয় ঘটল।

তবে এনসিপি নেতাদের উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর গুলি চালানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়। ফলে সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য হাসিলের ক্ষেত্রেও বড় দামও চুকানোর ঝুঁকি তৈরি হলো।

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনী নামলেও তাদের গুলি চালানোর বিষয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছিল বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্ক কয়েক মাস আগেই প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ শান্তি মিশন থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেখানো হয়েছিল তখন সেনাবাহিনীকে।

সাঁজোয়া যানে করে হাসনাত আব্দুল্লাহদের গোপালগঞ্জ ছাড়ার মুহূর্ত। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া।

এবার আবার গুলি চালানোর দৃশ্য প্রচার পেলে তার সেনাবাহিনীর জন্য অস্বস্তিকর হবে। তবে তাতে লাভ হবে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য। কারণ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারকে ঠিক বাগে আনতে পারছে না এই সরকার। ওয়াকার চাপে থাকলে সরকার একটু নির্ভাবনায় থাকে।

এরপর প্রশ্ন থাকে, সরকার কেন এমন পরিস্থিতি হতে দিল?

গোপালগঞ্জে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমরা দেখেছি, এখানে আর্মি নিষ্ক্রিয়, পুলিশ নিষ্ক্রিয় … আমাদের বলা হয়েছিল, এখানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এসে দেখেছি, এখানে পরিস্থিতি শান্ত নেই।”

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায়ই গোপালগঞ্জ শহরে ঢুকেছিল এনসিপির গাড়িবহর। সকালেই যখন পুলিশের গাড়ি পোড়ানো হলো, তারপরও সেই গাড়িবহর ঢুকিয়ে পরিস্থিতি আরও নাজুক করার ঝুঁকি কেন নিল প্রশাসন?

ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে গোপালগঞ্জে হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, যে সহিংসতা করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়েছে বিবৃতিতে; যার মধ্যে ছাত্রলীগকে গত বছরই নিষিদ্ধ করা হয়, এবছর আওয়ামী লীগের কার্যক্রমেও সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আবার প্রথম দফা হামলার পরও সমাবেশ করায় এনসিপির সাহসের প্রশংসা করা হয়, যার মধ্যদিয়ে সরকারের পক্ষপাত খুঁজে নিতে পারে যে কেউ।

বিক্ষুব্ধ জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে সেনা সদস্যরা।

হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার কথা বিবৃতিতে বলা হলেও কেন এই সহিংসতা ঠেকানো গেল না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই বিবৃতিতে।

তাতে প্রশ্ন আসে, সরকারও কি তবে এই সংঘাত চেয়েছিল? চাইলে কেন চাইবে?

সংঘাতের পর এনসিপির নেতাদের কারও কারও ফেইসবুক পোস্ট দেখে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকে।

হামলার ঘটনা নিয়ে এনসিপি নেতা আবদুল হান্নান মাসউদ অন্তর্বর্তী সরকারকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন, “একটা জেলায় জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা করবে নির্বাচন!!”

নির্বাচন কবে? ইউনূসের একেক রকম কথায় কারও ধন্দ যখন কাটছে না, তখন গোপালগঞ্জের ঘটনা সন্দেহ যে আরও বাড়াবে, তা অস্বাভাবিক নয়।

নির্বাচনের দিন-তারিখ না পেয়ে বেজার বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর পর এনসিপিরও বেধেছে। ফলে এনসিপি বেকায়দায় পড়ায় খুশি বিএনপির সমর্থকরা, যদিও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। 

 আর বাকি রইল আওয়ামী লীগ। অভ্যুত্থানের পর সব দিক থেকে চাপে নিষ্ক্রিয় দলটি গোপালগঞ্জ থেকে এনসিপি নেতাদের পলায়নে নিজেদের বিজয় ভাবতেই পারে।

সব মিলিয়ে সবারই কিছু না কিছু স্বার্থ উদ্ধারের সুযোগ দেখা যাচ্ছে। শুধু নেই সেই চারজনের, যারা বুধবার বেঘোরে প্রাণ হারালেন গোপালগঞ্জে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads