‘কোটা না মেধা, মেধা-মেধা’- এই স্লোগানে গত জুলাই মাসে কেঁপেছিল রাজপথ। আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের মূল কারণ ছিল সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
সেই কোটা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- “চাকরি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাবে না তো কি রাজকারের নাতি-পুতিরা পাবে?”
তার সেই কথা বিক্ষোভের আগুনে জ্বালিয়েছিল বারুদ। প্রতিক্রিয়ায় গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেরিয়েছিল মিছিল; স্লোগান ছিল- “তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার।”
সেই আন্দোলন রক্তাক্ত একটি অধ্যায় পেরিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার হটানোর আন্দোলন হয়ে উঠল। ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে গিয়ে উঠতে হলো শেখ হাসিনাকে।
তারপর অভ্যুত্থানকারী শিক্ষার্থীদের মত নিয়ে গঠিত হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অভ্যুত্থানের তরুণ নেতারা সেই সরকারের অংশও হলেন।
তবে যে কোটা নিয়ে আপত্তি থেকে জুলাই আন্দোলনের সূত্রপাত; এখন অভ্যুত্থানের সেই সরকারই ফিরিয়ে আনছে কোটা, ভাতা; সেই সঙ্গে চাকরিতে অগ্রাধিকারের কথাও বলছে। এই সবই জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের এখন স্কুলে ভর্তিতে কোটা বহালের খবরে সোশাল মিডিয়ায় চলছে তুমুল আলোচনা। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা কী দোষ করেছিল?
বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য যারা অসম সাহসে অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে সরকার।

স্বাধীনতার পর শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই কোটা সুবিধা পেতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ ২১ বছর বাদে ক্ষমতায় ফেরার পর ১৯৯৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এবং ২০১১ সালে তাদের নাতি-নাতনিদেরও এই কোটার সুবিধায় আনে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর ২০১৮ সালে সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা তার বিরুদ্ধে আদালতে গেলে গত বছরের জুন মাসে হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করে। তখন নতুন করে আন্দোলন শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে।
সেই আন্দোলন শেখ হাসিনা বল প্রয়োগ করে থামাতে চাইলে কয়েক মানুষ নিহত হয়; তাকে কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে গণবিস্ফোরণ ঘটে, পতন ঘটে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকার এসে অভ্যুত্থানে নিহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ ঘোষণা করে তাদের ভাতার আওতায় এনেছে। তাদের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। শেষে স্কুলে ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা, তাতে জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের জন্য রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অভ্যুত্থানে হতাহতদেতর জন্য ভাতা
গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সময়ই মাসিক ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, মার্চ মাস থেকেই ভাতা চালু হচ্ছে।
অভ্যুত্থানে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হবে। প্রতিটি পরিবার পাশাপাশি মাসে ২০ হাজার করে ভাতা পাবে।

জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি বলে আন্দোলনকারীরা দাবি করলেও সরকারিভাবে ৮৩৪ জন নিহত উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। আহতের সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি বলে আন্দোলনকারীদের দাবি।
আহতদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে চিকিৎসাসহ আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অতি গুরুতর আহতরা ক্যাটাগরি এ, গুরুতর আহতরা বি এবং সাধারণ আহতরা সি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
চিকিৎসার পরও শারীরিক অসামর্থ্যতার নিরিখে অন্যের সহায়তা ব্যতীত জীবনযাপনে অক্ষম, এসন ব্যক্তিদের এ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। এমন ৪৯৩ জন এককালীন ৫ লাখ টাকা পাবেন। এছাড়া মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসা সুবিধাও পাবেন তারা।
পর্যাপ্ত চিকিৎসার পর শারীরিক অসামর্থ্যতার নিরিখে অন্যের আংশিক সহায়তায় জীবন যাপনে সক্ষম ব্যক্তিদের বি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এমন ৯০৮ জন এককালীন ৩ লাখ টাকা পাবেন। সেই সঙ্গে মাসিক ১৫ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন।
চিকিৎসার পর বর্তমানে সুস্থ এমন আহতদের সি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। এমন ১০ হাজার ৬৪৮ জন এককালীন ১ লাখ টাকা এবং মাসিক ১০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন।
মুক্তিযোদ্ধারাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে মাসিক ভাতা পেয়ে থাকেন। এই ভাতার হার খুব কম ছিল এক সময়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে ভাতার পরিমাণ বাড়ায়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর আরও বাড়ানো হয়।
বর্তমানে ৬ হাজার ১৭৪ জন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পঙ্গুত্বের ধরন ভেদে ২৫ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা মাসিক সম্মানী ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া ৫ হাজার ৮১৬ শহীদ পরিবারকে মাসিক ৩০ হাজার, মৃত যুদ্ধাহত পরিবারকে মাসিক ২৫ হাজার, সাত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ পরিবারকে মাসিক ৩৫ হাজার, বীর উত্তম খেতাবধারীরা মাসিক ২৫ হাজার, বীর বিক্রম খেতাবধারীরা মাসিক ২০ হাজার ও বীর প্রতীক খেতাবধারীরা মাসিক ১৫ হাজার টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন।
চাকরিতে অগ্রাধিকারে প্রতিশ্রুতি
জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতরা ‘জুলাই শহীদ’ এবং আহতরা ‘জুলাই যোদ্ধা’ নামে অভিহিত হবেন বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যরা সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন বলে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান।
তিনি বলেন, বি ক্যাটাগরিতে যারা রয়েছেন, তাদের চিকিৎসার পর কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি-আধা সরকারি কর্মসংস্থান দেওয়া হবে তাদের।

সি ক্যাটাগরিতে থাকা আহতদের জন্য একই রকমভাবে পুনর্বাসনের সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানান প্রেস সচিব।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চাকিরতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে এনে রায় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। তবে সেই কোটার সুবিধা শুধু সন্তানরাই পাবেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
এখন পর্যন্ত সেই রায় বহাল রয়েছে। তবে হিসাব করলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে ঢোকার বয়স পেরিয়ে গেছে। ফলে এই কোটা কাগজে-কলমে থাকলেও এর দাবিদার পাওয়া দুষ্কর হবে।
আবার কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা তালিকা থেকে নিয়োগের প্রক্রিয়া আগেও ছিল, এখনও আছে।
স্কুলে ভর্তিতে কোটা
জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের স্কুল ভর্তিতে কোটার সুবিধা রেখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি অফিস আদেশ জারি হয়। রবিবার মাউশির ওয়েবসাইটে সেই আদেশ প্রকাশিত হয়েছে।
তাতে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য এতদিন যে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকত। তাতে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিবারও এখন ভাগ বসাতে পারবে।
আদেশে বলা হয়, “মুক্তিযোদ্ধা/শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ এ আহত বা শহীদ পরিবারের সদস্যদের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে।”
এই কোটার সুবিধা পেতে হলে আবেদনপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রমাণপত্র কিংবা গেজেটের সত্যায়িত অনুলিপি আবেদনপত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে।
আলোচনা-সমালোচনা
কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই সেই সরকারে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে সরব হয়েছিলেন।
তখন সারজিসের সেই কথাকে কোটা চাওয়ার সঙ্গে তুলনা করে কেউ কেউ তার সমালোচনা করেছিলেন।
এখন স্কুলে ভর্তিতে কোটা সংরক্ষণ করার আদেশ হওয়ার পর আবার আন্দোলনকারীদের সমালোচনা উঠছে।
এই আন্দোলনের কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমে যাওয়ার পাশাপাশি নৃগোষ্ঠীর কোটাও ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছিল। তখন আদিবাসী নেতারা তার সমালোচনা করেছিলেন।
এখন স্কুলভর্তিতে কোটা দেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা দীপায়ন খিসা ফেইসবুকে লিখেছেন, “কোটা সংস্কার বা কোটা বিরোধী আন্দোলন করে এখন আবার নতুন কোটা ব্যবস্থা চালু।”
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরীফুজ্জামান শরীফ লিখেছেন- “ফিরছে নাকি কোটা আবার/চিপায় পড়লো মেধা!/কেউ হইল উপদেষ্টা/বাকিরা সব গাধা!”
কোটা দেখে জুলাই আন্দোলন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। তাদের একজন লিখেছেন- “তার মানে হইলো- কোটা আসলে তাদের সমস্যা ছিলো না!জাতিকে প্রতারিত করার ‘অস্ত্র ছিলো!”
জুলাই অভ্যুত্থানকে প্রশ্নের মুখে পড়তে দেখে অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়েও সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।
একজন লিখেছেন- “নির্লজ্জের মত আবার কোটা মারাইতে গেল কেন ইন্টেরিম?? এতগুলা মানুষ মরলো কিসের জন্য?? ওরা যারা শহীদ হইলো তারা কি কোটা চেয়েছিল?? এদের এই উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তের জন্য গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর: