‘রহমতের বৃষ্টি’র মধ্যে মহাসমারোহে জুলাই অভ্যুত্থানের যে ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, তা সন্তুষ্ট করতে পারেনি অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিকে।
শুধু তাই নয়, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলও জানিয়েছে তাদের অসন্তুষ্টির কথা। গণসংহতি আন্দোলন বাদে অন্য সব বাম দল তো ঘোষণা পাঠের অনুষ্ঠানই বর্জন করেছে।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ‘তথাকথিত’ এই ঘোষণাপত্রকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে।
তাদের কথা কিছুটা সমর্থন পেল ডেভিড বার্গম্যানের কাছেও, যিনি আওয়ামী লীগ আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন।
বিএনপিই একমাত্র দল, যারা এই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে; যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ভার দেওয়া হয়েছে পরবর্তী সরকারকে।
আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনের মাঠে ক্ষমতায় যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। ফলে ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করার কাজটি তাদের হাতে যাচ্ছে ধরে নিয়ে এখন কী ঘোষণা দেওয়া হলো, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।
সেই কারণেই এই ঘোষণাপত্রের সংবিধানে সংযোজন নিয়ে অনিশ্চয়তার পথ তৈরি হলো বলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গত বছরের জুলাইয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা রক্তাক্ত এক অধ্যায় পেরিয়ে সরকারের পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। তাতে টলে যায় শেখ হাসিনার শাসন, ৩৬ দিনের আন্দোলনের পর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে আান্দোলন হলেও কোটা সংস্কার, নিপীড়নের বিচারের বাইরে আর কোনও দাবি সেভাবে ছিল না, শেষে গিয়ে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি তোলা হয় ৩ আগস্ট।
তবে অভ্যুত্থানের পর সংবিধানে আমূল পরিবর্তনসহ রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অভ্যুত্থানের কোনও ঘোষণাপত্র ছিল না, যা নিয়ে প্রশ্নও ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
যার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভ্যুত্থানের স্থায়ী স্বীকৃতির জন্য জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাড়া না পেয়ে তারা ডিসেম্বরে একক উদ্যোগে তা ঘোষণার উদ্যোগও নেয়। তখন সরকার সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে অভ্যুত্থানকারীরা ক্ষান্ত হয়।
তার সাত মাস পর অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণ ও মানিক মিয়া এভিনিউতে মঙ্গলবার ঘটা করে আয়োজনের মধ্যদিয়ে এই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।
কী আছে ঘোষণাপত্রে
বৃষ্টির মধ্যে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ইউনূস।
সবাইকে সালাম দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ঘোষণাপত্র পাঠের শুরুতে বৃষ্টির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আজকে দেশের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে জাতির যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য আমরা এসেছি, আল্লাহ তার জন্য রহমত বর্ষণ করছেন। আল্লাহর রহমত নিয়ে আমি এই ঘোষণাপত্র পাঠ করব।”
তারপর তিনি ২৪ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, যা রচিত হয়েছে অনেকটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদলে।

গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসাবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পরবর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করা।
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহতদের জাতীয় বীর হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে। পাশাপাশি শহীদ পরিবার, আহত এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রের শুরুতেই বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল।
“স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে।”
শেখ হাসিনার শাসনকাল নিয়ে শুরুতেই বলা হয়, “দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় এক-এগারোর মতো ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়।
“হাসিনা সরকারের আমলে তারই নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
ঘোষণাপত্র উপস্থাপনের সময় ইউনূসের পাশে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান।
এই ঘোষণাপত্রকে দলের পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, “বিএনপি বিশ্বাস করে এই ঘোষণাপত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যে অঙ্গীকার করেছে, তা পালনের মধ্যদিয়ে এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তরের কাজ শুরু হবে। সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সত্যিকারের প্রগতিশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের প্রক্রিয়া।”
জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানে সংযুক্ত করার ভার পরবর্তী সরকারের ওপর দেওয়াকেও স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি।

সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এটাই আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। এর বাইরে অন্য কোনও প্রক্রিয়ার কথা আমাদের জানা নেই।”
বুধবার জামায়াতের সংবাদ সম্মেলনে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের এই ঘোষণাপত্রকে একটি ‘অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি’ আখ্যায়িত করে বলেন, এতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টিসহ পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রাষ্ট্র সংস্কারে বিষয়টি ঘোষণাপত্রে না থাকায় হতাশা প্রকাশের পাশাপাশি পরবর্তী সরকারের হাতে দায়িত্ব দেওয়ায় তার বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তাহের।
তিনি বলেন, “ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ নেই। ঘোষণায় কখন কীভাবে তা কার্যকর করা হবে, তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে।
“পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ফজলুল করীমও পরবর্তী সরকারের হাতে দায়িত্ব দেওয়ায় ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের ওপর দিয়ে একে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাও করেন তিনি।
আলোচনা ছাড়াই জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করায় সিপিবি-বাসদ নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট সরকারি অনুষ্ঠানই বর্জন করে। তারা ঘোষণাপত্র পাঠের সময় পাল্টা প্রতিবাদ সমােবশ করে বলেছে, বিশেষ দু’একটি দলের সঙ্গে কথা বলে যে ঘোষণাপত্র করা হলো, তার দায়-দায়িত্ব তারা নেবে না। এজন্য ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েও তারা যোগ দেয়নি।
গণঅভ্যুত্থানকে ব্যবহার করে দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সক্রিয় হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে ফেলতে চাইছে বলেও অভিযোগ তুলেছে বাম জোট। আর ওই গোষ্ঠীর প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পক্ষপাত দেখাচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।
ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়নি বলে সরকারের সমালোচনা করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরও। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সব কিছুতেই এনসিপিকে ‘আশকারা’ দিয়ে যাচ্ছে।
“এই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার আগে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে বলে আমরা শুনেছি। তাহলে আমাদের প্রশ্ন, বিএনপি, জামায়াত, এনপিসি এই মিথ্যাচারের স্বীকৃতি দিয়েছে কি না?”
এনসিপির দিকে ইঙ্গিত করে নুর বলেন, “অন্যদের সব অবদানকে ম্লান করে আজ সরকারকে ব্যবহার করে কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে। সেই কিংস পার্টির কার্যকলাপ আপনারা দেখছেন। সে কিংস পার্টি আজ তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করছে, রাজনীতিকে কলুষিত করছে।”

জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়াকে স্বাগত জানালেও কিছু বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এনসিপিও সংবাদ সম্মেলন করে বুধবার। সেখানে দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “অভ্যুত্থানের এক বছর পর জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছে, সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিছু বিষয় যদি এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকত, তাহলে এই ঘোষণাপত্র আরও পরিপূর্ণ হতে বলে আমরা মনে করি।”
এই কিছু বিষয়গুলোর মধ্যে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির কথা বলেন তিনি। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অনুপস্থিতির কথাও তোলেন তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা সুস্পষ্ট না হওয়ায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আখতার বলেন, “শহীদের সংখ্যার ব্যাপারে প্রায় ১ হাজার শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ রিপোর্টে ১৪০০ জন শহীদ হয়েছেন বলে পরিসংখ্যান আমরা সকলের জানা। সরকার যে এক বছরে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা, আহতদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছে, তার একটি ছাপ আমরা এই ঘোষণাপত্রে পেলাম।”
ঘোষণাপত্রে এনসিপির সবচেয়ে বড় আপত্তি সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের ওপর দেওয়া নিয়ে।
আখতার বলেন, “আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে একটি নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়ে আসছি। সে লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি আমরা সরকারে কাছে করে এসেছি।
“যখন এই ঘোষণপত্রটি পরবর্তী সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, স্বভাবত আমরা যে গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধানে কথা বলছি, তা পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলো।”
আওয়ামী লীগ তাদের ফেইসবুক পাতায় দেওয়া এক বিবৃতিতে এই ঘোষণাপত্র প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, “অবৈধ দখলদার খুনি-ফ্যাসিস্ট ইউনূস গং শুরু থেকেই বিভেদের রাজনীতি করে আসছে। এরা পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও মূল্যবোধকে বিকৃত করতে এবং বাঙালির অর্জিত স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে ম্লান করতে অপচেষ্টা করে চলেছে।
“এরই ধারাবাহিকতায় সংবিধান লঙ্ঘনকারী এই দখলদার গ্রুপ তথাকথিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছে। এটা জাতিকে বিভক্ত করার নিকৃষ্ট দলিল হিসেবে কালবেলার সাক্ষ্য বহন করবে। যেখানে ইতিহাসের চরম বিকৃতি ও খণ্ডিত বয়ান উপস্থাপন এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশপ্রণোদিত হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চরম বিষোদগার করা হয়েছে।”
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের দৃষ্টিতে জুলাই ঘোষণাপত্র পক্ষপাতদুষ্ট, এটি প্রণয়ন হয়েছে আওয়ামী লীগবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেনের মেয়ে সারা হোসেনের স্বামী বার্গম্যান এক ফেইসবুক পোস্টে নিজের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
তিনি লিখেছেন, “এই ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশ, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নিয়ে বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও একতরফা। যারা আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করেন, এতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এটাকে একটি রাজনৈতিক বৈরিতা বলা যায়। ঘোষণাপত্রের অনেকটাই পড়ে মনে হয়, যেন এটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিরোধী ও সমালোচকদের লেখা একটি রাজনৈতিক বক্তব্য।”
ইতিহাসের ত্রুটিপূর্ণ অবস্থান এই ঘোষণাপত্রে রয়েছে মন্তব্য করে বার্গম্যান লিখেছেন, “১৯৭১ পরবর্তী ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার’ দায় ‘সংবিধানের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া ও কাঠামোর দুর্বলতার’ ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
“১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগের যতটা সফল হওয়ার কথা ছিল, ততটা না হওয়ার পেছনে নিঃসন্দেহে অনেক কারণ রয়েছে। তবে আমি কখনোই শুনিনি, সংবিধানের ‘খসড়া তৈরি’ ও ‘কাঠামো’ সেসব কারণের একটি। আমার মনে হয়, সংবিধান নিয়ে এই বিতর্ক উঠে এসেছে বিশেষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে। বাংলাদেশে তারা এখন ক্ষমতাশালী এবং নতুন একটি সংবিধানকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য কারণ খুঁজে বের করতে চায়।”

বার্গম্যান লিখেছেন, “২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তা উল্লেখ না করে ঘোষণাপত্রে এই ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে দলটি ‘ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী’ ছিল। এটি একেবারেই অসত্য। বাস্তবতা হলো, ক্ষমতায় থাকার সময় যতই গড়িয়েছিল, ততই অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
“আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালের বর্ণনা দিতে গিয়ে ঘোষণাপত্রে এই বিশেষণগুলো ব্যবহার করা হয়েছে: ‘গণবিরোধী’, ‘স্বৈরাচারী’, ‘মানবাধিকারবিরোধী’, ‘মাফিয়া ও ব্যর্থরাষ্ট্র’, ‘সীমাহীন দুর্নীতি’, ‘ব্যাংক লুট’ এবং অনুসরণ করা নীতিগুলো ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করছে’। এই বর্ণনাগুলোর কয়েকটি অবশ্যই সত্য। কিন্তু ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের অন্য আরেকটি দিক পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নারীশিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছিল তারা।”
আওয়ামী লীগ আমলে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঘোষণাপত্রের বর্ণনা অতিরঞ্জিত ঠেকেছে বার্গম্যানের কাছে।
ঘোষণাপত্রের কিছু ইতিবাচক দিক নিয়ে তিনি লিখেছেন, “এটি আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকে বেশ নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ভালোভাবে তুলে ধরেছে।”
“সব মিলিয়ে, এটা উল্লেখযোগ্য যে অধ্যাপক ইউনূস, যিনি দলীয় রাজনীতিতে জড়িত না থাকার সুবিধাজনক অবস্থান থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন, তিনি এই ঘোষণাপত্রে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন। কে জানে নির্বাচনের পর অধ্যাপক ইউনূসের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে,” লিখেছেন বার্গম্যান।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করছেন, সংবিধানের তফসিলে জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলায় তার প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা থাকল না। ফলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তাদের ঘোষণাপত্রটি বদলানোর সুযোগ থাকছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তফসিল হল সংবিধানের অংশ, কিন্তু তার কোনও প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নাই। তফসিলের ধরনের উপর নির্ভর করে, এইটা কী হবে? যদি ঘোষণাপত্র তফসিলে আসে, তাহলে এর কোনও প্রায়োগিক বাধ্যবাধকতা নাই। থাকবে না।
“যখন সংসদে আসবে, কোন দলে কত সদস্য থাকে, কার কী মত থাকে, সবাই তো এটার সাথে একমত নাও হতে পারে। ঠিক প্রত্যেকটা শব্দ যেভাবে লিখা হয়েছে, তার সাথে একমত নাও থাকতে পারে।”
একটি সংগঠন বা রাজনৈতিক দল না দিয়ে ঘোষণাপত্রটি সরকার দেওয়ায় এটি জোরদার হল কি না- এমন প্রশ্নে শাহদীন মালিক বলেন, “এখন তো কোনো আইনগত ভিত্তি নাই। মানে এটাকে তো কোনো আইনি দলিল বলা যাবে না। কারণ, আইন তো করবেন সংসদ সদস্যরা।
“এর মানে আমার আইনগত দৃষ্টি থেকে এটার কোনো প্রায়োগিক মূল্য এই মুহূর্তে নাই। যদি এটা সংবিধানের তফসিলে আসে তাহলে হয়তো ওটা, কোনো কোনো সময় ওটার আমরা আশ্রয় নিতে পারব। তফসিলে কীভাবে আসে, সেটার উপরও নির্ভর করবে।”
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম এনিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংবিধানে কীভাবে থাকবে, তা নিয়ে দলগুলোর ভিন্নমত থাকলেও এ ঘোষণাপত্রের আলোকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
“এইটাই মূল পয়েন্ট। এটি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ; এটার একটা স্বীকৃতি থাকা উচিৎ। তা না হলে মানুষ এটাকে ভুলে যাবে “
এ সম্পর্কিত আরও খবর: