বাচ্চা হচ্ছে না, সমাধানই বা কী?

infertility (1)

বর্তমানে অনেক দম্পতিই সন্তান জন্মদানে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। শুধু শহুরে জীবনের চাপ নয়, বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক ও পরিবেশগত কারণেও সন্তান ধারণে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই এই হার বাড়ছে।

ভারতের একটি নামকরা হাসপাতালের সামনে কথা হয় বাংলাদেশ থেকে আসা এক দম্পতির সঙ্গে। তাদের বিয়ে হয়েছে এক দশকের বেশি, সন্তানের মুখ দেখেননি। নানা হাসপাতালে ধর্ণা দিয়ে করিয়েছেন নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা, তবে সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা অজানাই রয়ে গেছে। কোনো কোনো চিকিৎসক অবশ্য তাদেরকে টেস্টটিউব শিশুই একমাত্র উপায় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

এই শিক্ষিত দম্পতির একজন ব্যাংকার এবং অপরজন একটি টেলিকম কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করছেন।

ওই নারী জানান, বিয়ের পর তারা একটু সময় নিয়েছিলেন নিজেদের ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনা করে। ততদিনে পাঁচ বছর চলে গিয়েছে।

“বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আর হচ্ছিল না। ঢাকায় নানা হাসপাতালে গিয়েছি, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো সমাধান আসছে না।”

নারীদের বন্ধ্যাত্বের কারণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সন্তান ধারণের চেষ্টা করার পর টানা এক বছর সময়কাল যদি কেউ সফল না হন তাহলে তাকে ইনফার্টাইল বা সন্তান ধারণে অক্ষম হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে এই সমস্যাটি এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে, যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

স্ত্রী রোগের চিকিৎসক ডা. সাঈদা আফরোজ মুমু যেমন বলছিলেন, সত্যি বলতে সমস্যাটা কার সেটি জানাই বেশি জরুরি। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। অথচ নারী বা পুরুষের যে কেউ এর কারণ হতে পারেন। অনেক নারীর যেমন থাইরয়েডজনিত সমস্যা থাকে, তেমনি পুরুষেরও থাকে বন্ধ্যাত্বজনিত অক্ষমতা।

নারীদের বেশ কিছু বিষয়ে অক্ষমতা থাকতে পারে বলে জানান ডা. মুমু।

  • প্রেগন্যান্সির জন্য জরুরি পলিসিস্টিক ওভারি, যার মাধ্যমে একটা করে ওভাম আসার কথা, সেটা আসে না।
  • জরায়ুর কিছু সমস্যা থাকে যা জন্মগত হতে পারে আবার অসুখের কারণে হতে পারে।
  • জন্মগত সমস্যার কারণে হয়ত ডিম আসছে না, তার টিউব ব্লক, জরায়ু যেটা আছে সেটা বাচ্চাদের মতো।
  • আরও কিছু অসুখ আছে, যেমন: ওভারিয়ান চকলেট সিস্ট, এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণে হতে পারে।
  • হরমোনের কারণেও হতে পারে। যেমন থাইরয়েডের সমস্যার কারণে হতে পারে।
  • আর যৌনবাহিত রোগের কারণে মেয়েদের প্রজনন অঙ্গগুলোর ক্ষতি করে। সেজন্য বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।

মোটাদাগে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS), হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, ফ্যালোপিয়ান টিউব বন্ধ থাকা, উচ্চ বয়সে গর্ভধারণের চেষ্টা ও উত্তেজনাহীন বা অনিয়মিত মাসিক চক্র নারীদের সন্তান ধারণে অক্ষমতার মূল কারণ।

পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ

মূলত পুরুষরা বন্ধ্যত্বের সমস্যা নিয়ে নিজেদের উপর দায় নিতে চান না। বরং দায় চাপিয়ে দেন স্ত্রীর উপর। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা চলে নারীর। আর তাতে কোনো ফল আসে না।

পুরুষদের বন্ধ্যত্বের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

প্রতীকী ছবি।
  • একটা কারণ এজোস্পার্মিয়া, অর্থাৎ বীর্যের মধ্যে শুক্রাণু নেই। তার নালির কোথাও বাধা সৃষ্টি হয়েছে তাই শুক্রাণু মিলতে পারছে না। শুক্রাণু তৈরি হওয়ার যে স্থান অণ্ডকোষ, কোন কারণে সেটি তৈরিই হয়নি।
  • অনেক সময় শুক্রাণু থাকে কিন্তু পরিমাণে কম থাকে।
  • আবার শুক্রাণুর পরিমান ঠিক আছে কিন্তু মান ঠিক নেই। যার ফলে সে ডিম ফার্টিলাইজ করতে পারে না।
  • এছাড়া টেস্টোস্টেরন হরমোনও ‘সিক্রেশন’ হতে হবে।
  • প্রজনন অঙ্গে কোন ধরনের আঘাত
  • অস্ত্রোপচারের কারণে সৃষ্ট বাধা
  • প্রজনন অঙ্গে যক্ষ্মা
  • ডায়াবেটিস
  • ছোটবেলায় মাম্পস
  • এমনকি মাথায় চুল গজানোর ঔষধও পুরুষদের সন্তান ধারণের অক্ষমতার উৎস।

বন্ধ্যাত্বের সমাধান নেই?

৪৭ বছর বয়সী কুমিল্লার হাসিবুল আহসান জানান, অনেক দেরিতে তারা জেনেছেন তার নিজের ও স্ত্রী দু’জনেরই সন্তান ধারণে জটিলতা রয়েছে। অথচ এতদিন তিনি স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছেন, সব দায় চাপিয়ে দিয়েছেন তার উপর।

বিশ্বে এখন বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার নানা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তার আগে জানতে হবে সমস্যাটি আসলে কার।

ডা. সাঈদা আফরোজ বলেন, “বছরখানেক চেষ্টার পরও বাচ্চা না এলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। তবে বয়স ত্রিশের কোঠা পেরিয়ে গেলে অপেক্ষা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

তবে সবার আগে জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্যসম্মত বিষয়াদি অনুসরণ করতে হবে। যেমন:

  • মেয়েদের খাদ্যাভ্যাস ঠিক করতে হবে।
  • ক্যালরি খাওয়া কমাতে হবে।
  • ঘরে রান্না খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
  • ব্যায়াম করতে হবে।
  • শরীরের স্বাভাবিক ওজন রক্ষা করতে হবে।
  • জীবনাচারণ পরিবর্তন করতে হবে।
  • দিনে ঘুমানো, রাতে জেগে থাকার মত অভ্যাস বদলাতে হবে।
  • বয়স থাকতে বাচ্চা নিতে হবে।

নারীদের ডিম্বাণুজনিত স্বল্পতা থাকলে হরমোন ইনজেকশনের ব্যবস্থা রয়েছে। ডিম্বাশয়, এর নালী ও জরায়ুর সমস্যা দেখতে ল্যাপারস্কপি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে স্টেম সেল থেরাপি।

সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতির দেহ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে কৃত্রিম পরিবেশে তা নিষিক্ত করে পুনরায় স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা বা টেস্টটিউব বেবির ব্যবস্থা বহুল প্রচলিত।

যদিও বাংলাদেশে সন্তানহীনতার চিকিৎসা যতটুকু রয়েছে তার বেশিরভাগেই নারীদের জন্য এবং তা মূলত বিভাগীয় শহর ভিত্তিক।

নারীদের মতো পুরুষদের জন্যও রয়েছে নানা চিকিৎসা। তবে তার আগে প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত।

  • ঔষধ দিয়ে শুক্রাণু বাড়ানো যেতে পারে।
  • স্বাভাবিক হচ্ছে প্রতি মিলিতে চল্লিশ থেকে ১২০ মিলিয়ন শুক্রাণু থাকার কথা। যদি সংখ্যাটা ১০ মিলিয়নের নিচে নেমে যায়, তাহলে কৃত্রিম গর্ভধারণে যেতে হবে।
  • যদি পুরোপুরি ‘অবস্ট্রাকশন’ হয়ে থাকে যে, শুক্রাণু আসছে না, তাহলে দেখতে হবে অণ্ডকোষটা সক্রিয় আছে কিনা।
  • অণ্ডকোষ সক্রিয় থাকলে সেখান থেকে সুঁই দিয়ে শুক্রাণু নিয়ে এসে টেস্টটিউব পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেয়া যায়।

তবে এটিও সত্যি বিশ্বব্যাপী পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় সাফল্যের হার কম। নারী পুরুষ দুজনের জন্যই বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি।

আরও পড়ুন