স্বামী-স্ত্রীকে রামদা দিয়ে হামলা করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ঘটনাটি রাজধানীর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের।
ভিডিওতে দেখা যায়, কিশোর গ্রুপের দুই সদস্য এই দম্পতিকে রামদা দিয়ে আঘাত করছে। জীবন বাঁচাতে ওই নারীকে দেখা যায় হাত জোড় করে চাইছেন ক্ষমা।
প্রত্যক্ষদর্শীর উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান জানান, ঘটনার শুরুটা প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে। কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা উত্তরা সেক্টরের ভেতরে উচ্চ শব্দে মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে চালাচ্ছিল। এসময় রিকশাকে ধাক্কা দেয় তারা।
“এর প্রতিবাদ করেন রিকশাচালক। পাশের আরেকটি বাইকে ছিলেন হামলার শিকার দম্পতি। তারাও জানান প্রতিবাদ। তখন ধাক্কা দেওয়া মোটরসাইকেলের দুই আরোহী কিশোর গ্যাংয়ের অন্য সদস্যদের ডেকে আনেন। পরে ওই দম্পতির ওপর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করেন,” যোগ করেন ওসি।
আশেপাশের লোকজন ঘটনার ভিডিও করলেও ভয়ে শুরুতেই কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে অবশ্য স্থানীয়রা এসে দুই হামলাকারী মোবারক হোসেন (২৫) এবং রবি রায়কে (২২) ধরে উত্তমমধ্যম দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে।
শুধু উত্তরায় নয়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই হামলার শিকার হন সাধারণ মানুষ। বাদ যায়নি পুলিশও।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হন পুলিশের চার সদস্য। হামলার ঘটনার নেপথ্যে রায়েরবাজার বোর্ড ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ জড়িত বলে জানায় পুলিশ।
গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের মধ্যে এক কলা ব্যবসায়ী ও কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এটি ছিল তাদের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।
গত ১২ নভেম্বর শাখাওয়াত হোসেন ও তার বন্ধু মো. আলমগীর হোসেন উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে থেকে হাউজ বিল্ডিংয়ে যাওয়ার জন্য অটোরিকশা নেন। তখন আটক এক কিশোরও তাদের সঙ্গে একই রিকশায় ওঠে। যাওয়ার পথে কিশোর গ্যাংয়ের ৭-৮ জনের সহায়তায় দুই বন্ধুকে ভয় দেখিয়ে দুটি মোবাইল ও নগদ ১৯ হাজার ৬০০ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া নেয়। পরে তাদের আটকে রেখে পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে।
রাজধানীতে এখন রীতিমত আতঙ্ক হয়ে ওঠছে ‘কিশোর গ্যাং’।
ডিএমপির তথ্য বলছে, প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ১২৭টি। ৫ আগস্টের আগে ঢাকায় এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৮২। কিন্তু বর্তমানে ঢাকার প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে এক হাজার সদস্য রয়েছে।
আগে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা থাকলেও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এই গ্রুপগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানামুখী অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। নিজেদের হিরোইজম জাহির করতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে যুক্ত হচ্ছে এসব কিশোর-তরুণ। এতে আতঙ্কিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর-পাড়া-মহল্লার বাসিন্দারা।
ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক জানান, ৫ আগস্টের পর বেপরোয়া কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরতে ডিবি কাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন গ্যাং সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যারা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও হুঁশিয়ার দেন গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমাতে ডিএমপির ৫০ থানা কাজ করছে। ঢাকায় এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের প্রতিদিনই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।”
‘অপারেশন ডেভিল হান্টেও’ কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক দ্য সান ২৪ কে বলেন, “বিভিন্ন শ্রেণিকরণের মধ্য দিয়ে যেসব তরুণ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে, তাদের সংশোধন করা ছাড়া কোনো পথ নেই। কারণ সমাজের উচ্চবিত্ত বা আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবারগুলো তরুণদের অপরাধ আর সমাজের সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের কিশোরদের অপরাধের ধরন এক নয়।”
কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, “শেকড় থেকে অপরাধ প্রবণতা
উৎপাটন জরুরি। সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে ব্যত্যয়গুলো রয়েছে সেগুলো সংশোধন করতে হবে। আইনের বিষয়গুলোতে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। পাশাপাশি সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকদের এগিয়ে আসা দরকার।”
রাস্ট্রকে শুধু অপরাধীকে নিয়ন্ত্রণ নয়, অপরাধ প্রবণতার মূল কারণ নির্ণয়ে আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই শিক্ষক।