ভাইরাল কাল হলো রনির জন্য

ঢাকার কারওয়ান বাজারের তরমুজ বিক্রেতা রনি ভাইরাল হওয়ার পর এখন ব্যবসা ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের তরমুজ বিক্রেতা রনি ভাইরাল হওয়ার পর এখন ব্যবসা ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে।

ছুটছে সবাই ভাইরাল হতে। মোহাম্মদ রনি চায়নি, কিন্তু ভাইরাল তিনি হয়ে গেছেন। নাম ছড়িয়ে পড়ছে, সাংবাদিকরা আসছেন, ভিডিও করতেও আসছেন অনেকে। শুরুতে ভালোই লাগছিল রনির, তাকে নিয়ে ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটকের ভিডিওগুলো তারই সাক্ষী।

কিন্তু এখন তার ব্যবসাই লাটে ওঠার জোগাড়। ঢাকার কারওয়ান বাজারের এই তরমুজ বিক্রেতা ভিড়ের চাপে ব্যবসা চালাতে না পেরে দিয়েছিলেন আত্মহত্যার হুমকি। তাতেও কাজ না হওয়ায় ব্যবসা ফেলে দিয়েছেন গা ঢাকা। খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে কথা!

রনির ভাইরাল হওয়ার খবরের সঙ্গে তার বিপাকে পড়ার খবরটিও এসেছে বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যমে।

রনির বাড়ি ঢাকার পাশের মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। কারওয়ান বাজারে প্রায় দেড় দশক ধরে ফল বিক্রি করেন তিনি। বাবা, দাদার হাত ধরেই তার এই ব্যবসায় আসা।

তবে রনি আলোচনায় আসেন তরমুজের বাইরের দিকটি দেখে ভেতরের অংশ কতটা লাল, তা বলতে পারার জন্য। গত রোজায় কারওয়ান বাজারে অন্য বিক্রেতাদের সঙ্গে পাল্লা বিক্রি করার সময় ‘ওই কীরে কী, মধু, মধু …. রসমালাই’ কথাটি বলতেন রনি। তা ভিডিও করে কেউ একজন সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিলে ভাইরাল হয়ে যান রনি।

এরপর কারওয়ান বাজারে এসে সবাই খোঁজেন রনিকে। বিশেষ করে ইউটিউবার ও টিকটকাররা। তার দোকানের সামনে বাড়তে শুরু করে ভিড়। তখন নিজেও সোশাল মিডিয়ায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন রনি। কিন্তু রমজানের অর্ধেক যেতেই রনি পড়ে যান সমস্যায়।

গত ১৬ মার্চ সোশাল মিডিয়ায় নিজের চ্যানেলে একটি ভিডিও পোস্ট করে আত্মহত্যার হুমকি দেন রনি। তিনি বলেন, প্রতিদিন

কনটেন্ট ক্রিয়েটররা তার দোকানের সামনে গিয়ে যেভাবে ভিড় জমাচ্ছে, তাতে তিনি স্বাভাবিকভাবে তরমুজ বিক্রি করতে পারছেন না।

“আমার দেড় লক্ষ টাকার মাল পচে যাচ্ছে। আমি বিক্রি করতে পারতেছি না। আমারে ভালো রাখেন। কর্ম করে খাইতে দেন ভাই। আমারে বিরক্ত করবেন না ভাই,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তিনি।

এর তিন দিন পর টিবিএ ‘র সাংবাদিক কারওয়ান বাজারে গিয়ে রনির খোঁজ পাননি। দোকানে ছিলেন তার ভাই মোহাম্মদ রকি। তিনি বলেন, “আমার ভাই সাংবাদিক, ভ্লগার ও টিকটকারদের কারণে পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষ আসতো এবং দোকানের চারপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতো। তারা নিজেরা তরমুজ কেনার জন্য আসত না, আবার আসল ক্রেতাদেরও ঢুকতে দিত না।”

রনির দোকানে ভিড়ের জন্য আশপাশের দোকানিরাও বিক্রি করতে পারতেন না। তারা বিরক্ত হচ্ছিলেন রনির ওপর। তখন রনি মুন্সীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে চলে যান বলে তার ভাই রকি জানান।

সেই সময়েই রনির খোঁজে নামেন প্রথম আলোর সাংবাদিক। রকির কাছ থেকে রনির একটি নম্বর নিয়ে ফোন করলেও তা বন্ধ পান। তখন আরেকটি নম্বর নিয়ে তাতে যোগাযোগ করলে রনি জানান, তিনি পুরান ঢাকায় রয়েছেন।

১৮ মার্চ রনি আসেন কারওয়ান বাজারে, তবে মুখে মাস্ক পরে। সাংবাদিকের প্রশ্নে রনি বলেন, তাকে যেন কেউ চিনতে পারে, সেজন্যই মাস্কে মুখ ঢেকেছেন তিনি।

রনি বলেন, ভাইরাল হওয়ার পর এখন তাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। কেননা তার দোকানের ব্যবসা তো লাটে উঠছেই, আশপাশের দোকানিরাও বিরক্ত হচ্ছিলেন। তখন ভাইয়ের হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে লুকিয়ে পড়েন তিনি।

কারওয়ান বাজারে সবজির আড়তের সামনে রনির দোকানের পাশের এক দোকানি বলেন, “সে (রনি) যখন দোকানে আসে, তখন আশপাশের লোকজন থেকে শুরু করে ইউটিউবাররা ভিড় করে। আমাদের দোকানে কাস্টমার আসতে পারে না। মাল বেচা-কেনা হয় না।”

সেখানে দীর্ঘদিন ধরে লেবু বিক্রি করে আসা আরেক দোকানি বলেন, রনি ভাইরাল হওয়ায় তারও ক্ষতি হয়েছে। আগে প্রতিদিন আড়াই থেকে ৩ হাজার লেবু বিক্রি করতেন তিনি। এখন ৫০০টি বিক্রি করতেই কষ্ট হয়।

ভাইরাল রনি ব্যবসায় যেমন ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তেমনি প্রতারণার শিকারও হয়েছেন বলে জানান।

কিছু প্রতিষ্ঠান রনিকে তাদের বিজ্ঞাপনে নিয়েছে। কত টাকা দিয়েছে- জানতে চাইলে রনি প্রথম আলোর সাংবাদিককে বলেন, “সবাই আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমাকে মোবাইল গিফট করবে বলে একটি দোকানে নিয়ে বিজ্ঞাপন করে ছেড়েছে, কিন্তু আমাকে কিছুই দেয়নি। ডেকে নিয়ে তারা আমাকে টাকা দেয়নি, বরং নাটক করেছে।”

শুধু একটি প্রতিষ্ঠান তার কাছ থেকে কিছু তরমুজ কিনেছে। আর বাকি সবাই প্রতারণা করেছে, বলেন রনি।

আরও পড়ুন