বঙ্গোপসাগরে যখন রুশ রণতরী, তখন ঢাকায় আসছেন মার্কিন ২ কর্মকর্তা

শুভেচ্ছা সফরে বঙ্গোপসাগরে এসেছে রুশ রণতরী রেজকি। ছবি: আইএসপিআর
শুভেচ্ছা সফরে বঙ্গোপসাগরে এসেছে রুশ রণতরী রেজকি। ছবি: আইএসপিআর

বঙ্গোপসাগরে যখন রাশিয়ার তিনটি রণতরী নোঙর করে আছে, তখন বাংলাদেশ সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা। ঘটনাটি কী কাকতালীয়? যদি কাকতালীয় হয়ও, তাহলে ঘটনাটি বেশ কৌতূহল জাগানিয়া।

বৈশ্বিক রাজনীতির দৃশ্যপট কিংবা প্রেক্ষাপট অনেক বদলে গেলেও এই ঘটনা একাত্তরের স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার মতো। ১৯৭১ সালে যখন বাঙালি স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, তখন পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার পাল্টায় তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা সোভিয়েত রাশিয়া ভারত মহাসাগরে পাঠিয়েছিল কয়েকটি রণতরী।

সেসব রুশ রণতরীতে গাইডেড মিসাইল এবং পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিনও ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সেই কালে একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছিল। যদিও আমেরিকান রণতরী বঙ্গোপসাগরে ভেড়ার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় স্বীকারে সেই যাত্রায় পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানো যায়।

সেই সোভিয়েত ইউনিয়নও আর নেই, ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিও অনেকটাই গেছে বদলে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের দৌলতে রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কমতি নেই। দুই দেশের শত্রুতা কমেছে, তাও বলা যাচ্ছে না এখনও।

তার মধ্যে বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলে দুই পরাশক্তির ভিন্ন অবস্থান গত বছর থেকেই রয়েছে আলোচনায়।

গত বছরের আগস্টে অভ্যুত্থানের ছয় মাস আগেই নির্বাচনের পূর্বক্ষণে রাশিয়া সতর্ক করে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মদদে বাংলাদেশে আরব বসন্তের মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।

তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অভিযোগ করেছিলেন, তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কর্তৃ্ত্ব চায়, এমন অভিযোগও করেছিলেন তিনি।

তার এসব অভিযোগ অবশ্য ওয়াশিংটনের তৎকালীন জো বাইডেন সরকার উড়িয়ে দেয়। অভ্যুত্থানের পেছনে নিজেদের কোনো হাত থাকার কথাও অস্বীকার করে।

কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে অনেকে বিশ্বাস করেন, জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে ‍ওয়াশিংটন কোনো না কোনোভাবে জড়িত।

গত আগস্টে গঠিত ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মতভেদ মাঝে-মধ্যেই আসছে আলোচনায়।

এরমধ্যে জেনারেল ওয়াকার রাশিয়া সফর করে আসার পরদিন রোববারই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়ল রাশিয়ার নৌবাহিনীর তিনটি যুদ্ধজাহাজ।

এগুলো চার দিনের শুভেচ্ছা সফরে এসেছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

রণতরী তিনটি হলো- রেজকি, হিরো অব দি রাশিয়ান ফেডারেশন আলদার সিদেনঝপভ ও পেচেঙ্গা।

জাহাজ তিনটি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছালে নৌবাহিনীর জাহাজ ‘বানৌজা খালিদ বিন ওয়ালিদ’ এগিয়ে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়। এরপর চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়লে নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা স্বাগত জানান রুশ কর্মকর্তা ও নাবিকদের। বাংলাদেশে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতও এসময় উপস্থিত ছিলেন।

তিনটি যুদ্ধজাহাজে আসা রুশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা নেভাল একাডেমি, নৌবাহিনী প্রশিক্ষণ ঘাঁটি ও জাহাজ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য পরিচালিত বিএন আশার আলো স্কুল পরিদর্শন করবেন বলে আইএসপিআর জানায়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা রাশিয়ান জাহাজ তিনটি পরিদর্শন করবেন।

রণতরীগুলোর এই শুভেচ্ছা সফরে দুই দেশের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নাবিকদের পেশাগত বিষয়ে মতবিনিময়, ভবিষ্যৎ প্রশিক্ষণ ও পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক আরো জোরদার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এর আগে গত ৭ এপ্রিল রাশিয়া সফরে গিয়ে দেশটির উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন জেনারেল ওয়াকার।

ওই সব বৈঠকে তিনি প্রশিক্ষণ সহায়তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং যৌথ প্রশিক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেন বলে আইএসপিআর জানায়। বাংলাদেশে রুশ সহযোগিতায় নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধান নিয়েও আলোচনা করেন তিনি।

রাশিয়া থেকে ১০ এপ্রিল সেনাপ্রধান যান ক্রোয়েশিয়া। সেই দেশ সফর শেষে শনিবার দেশে ফেরেন তিনি। তার এক দিন বাদেই চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে রুশ রণতরীগুলো।

আইএসপিআরের তথ্য অনুযায়ী, শুভেচ্ছা সফর শেষে রুশ রণতরী তিনটি আগামী ১৬ এপ্রিল, বুধবার বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে।

তার একদিন আগে ১৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার বাংলাদেশে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল অ্যান চুলিক। পরদিন তার সঙ্গে যোগ দেবেন পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এন্ড্রু আর হেরাপ।

যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই কর্মকর্তার সফরের খবর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এরই মধ্যে নিশ্চিত করেছেন।

অর্থাৎ চুলিক ও হারপ ঢাকায় মিলিত হওয়ার দিনই চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবে রুশ রণতরীগুলো।

রুশ রণতরীগুলো শুভেচ্ছা সফরে এসেছে, যা আইএসপিআর জানিয়েছে। মার্কিন দুই কর্মকর্তার আসার কারণ কী? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সংস্কার এবং মিয়ানমার পরিস্থিতিসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার জন্য আসছেন তারা।

এন্ড্রু হেরাপ আসার সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুসান স্টিভেনসনকেও নিয়ে আসবেন। রোহিঙ্গা সঙ্কটের কেন্দ্র এই মিয়ানমার, যা নিয়ে ভুগতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ফেরার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এই প্রথম উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা বাংলাদেশে আসছেন।

এরমধ্যে গত মার্চে অনেকটা নিভৃতে বাংলাদেশে এসে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে যান যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গ্যারি পিটার্স। ডেমোক্রেটিক পার্টির এই আইনপ্রণেতা এক দিনের সফরে এসে সামরিক বাহিনীর প্রধানের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

গ্যারি পিটার্স সেনেটের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গভার্নেন্স অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং আর্মড সার্ভিস কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। তার সফরের সঙ্গে প্রতিরক্ষাবিষয়ক আলোচনাই মুখ্য ছিল বলে ধারণা করা যায়।

এদিকে চুলিক ও হেরাপ অন্তর্রর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করতে পারেন বলে খবর এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা এন্ড্রু হেরাপ ও নিকোল অ্যান চুলিক।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের দিকে নজর সব পরাশক্তিরই রয়েছে। বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থান যেমন, তেমনি মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ এই অঞ্চল নিয়ে তাদের সমীকরণ আরও জটিল করে তুলেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দৈনিক ইত্তেফাককে বলেন, “মিয়ানমারের পরিস্থিতি যেভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, যেটাকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে দেখছে।”

বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রবেশ মিয়ানমারের মাধ্যমে। দেশটির সামরিক সরকার বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ হিসাবেই পরিচিত। চীনের সেই প্রভাব ভাঙতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়িয়ে থাকা রাশিয়ার আবার বাংলাদেশে স্বার্থ রয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে থাকা চীন আবার বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যেতে দিতে চাইবে না। আঞ্চলিক শক্তি ভারত আবার পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে নানা সম্পর্কে জড়িয়ে থাকলেও তার আঞ্চলিক আধিপত্য খর্ব হতে দিতে চায় না।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের চীন সফর এবং সেখানে একটি বক্তব্য যে নয়া দিল্লির ক্ষোভের কারণ হয়েছে, তা স্পষ্ট। এর মধ্যে ওয়াশিংটনে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের কথাও তুলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে এখন অবধি বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং দেশটির গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড সম্প্রতি ভারত সফরে এসে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন।

কিন্তু বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যখন বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে, তখন বাংলাদেশের সরকার প্রধানের চীন সফর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তার সফরকে গুরুত্বের সঙ্গেই দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন