অ্যালগরিদম, দর্শক এবং নির্মাতারা কেন অনলাইনে কাঁদতে ভালবাসে?

Sadbait

মানুষ দুঃখী হতে চায় না বলে থাকলেও আদতে তাদের অনলাইন অভ্যাস কিন্তু সেটা বলে না! অনলাইনে মানুষ অন্যের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে, আর এ কারণেই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণে এ ধরনের কনটেন্টে ঝুঁকছে নির্মাতারা।

স্পন্সরড মিথ্যা প্রচারণা, সফল কন্টেন্ট নির্মাতা হতে চাওয়া, পণ্য বিক্রি করতে চাওয়া বা অনুসারীর সংখ্যা বাড়াতে চাওয়ার একটি প্রমাণিত উপায় আছে, আর তা হলো মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়া।

সোশাল মিডিয়ার কন্টেন্ট নির্মাতাদের বিরুদ্ধে দর্শকদের রাগিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ক্ষুব্ধ করার কাজটি তারা জেনে বুঝেই করেন, যাতে দর্শকরা ক্ষুব্ধ হয়ে কন্টেন্টে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং সংযুক্তি বাড়ায়, যাকে ‘রেজবেট’ নামে ডাকা হয়।

বিষয়টি সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্যও দায়ী করা হয়ে থাকে।

তবে রাগই একমাত্র অনুভূতি নয় যার বশবর্তী হয়ে অনুসারীরা পোস্টে প্রতিক্রিয়া জানায় বা পুনরায় শেয়ার করে। বিষাদ বা বেদনার অনুভূতি থেকেও এমনটি করে থাকে।

সম্প্রতি ইন্টারনেট এমন প্রবণতায় ভরে গেছে যাকে ‘স্যাডবেইট’ বলা হয়ে থাকে। বিষয়টি তুলনামূলকভাবে কম সাড়া ফেললেও আজকের দিনের সবচেয়ে সফল কনটেন্ট বিষাদ এবং অতিনাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবকরাও নিজেদের কান্নার ভিডিও শেয়ার করছেন। আর প্রতারণাকারীরা কঠিন জীবনযুদ্ধের গল্প দিয়ে শিকার ধরছেন।

২০২৪ সালে টিকটক ব্যবহারকারীরা ‘কোরকোর’ নামে একটি বিষণ্ণ ধাঁচের ভিডিও দিয়ে কয়েকশ’ মিলিয়ন ভিউ অর্জন করে, যাতে বিষণ্ন মিউজিকের সঙ্গে সিনেমা ও খবরের বিষাদমাখা ক্লিপ দেখা গেছে।

সচরাচর দুঃখের অনুভূতি মানুষ এড়িয়ে যেতে চায় বলে মনে হলেও কষ্টকর পোস্টগুলো মানুষের পাশাপাশি অ্যালগরিদমের মনোযোগও সহজেই আকর্ষণ করে। তাই স্যাডবেইটের সফলতা শুধু ইন্টারনেটেরই নয়, আমাদের সম্পর্কেও অনেক কিছু বলে।

ফিনল্যান্ডের তামপেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক সোমা বসু বলেন,  “রাগ, দুঃখ, ঘৃণা বা হাসির মতো যেকোনো শক্তিশালী আবেগের প্রদর্শন দর্শকদের আকর্ষণ করে।”

মিডিয়া কীভাবে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি।

সোমা বসু বলেন, নির্মাতারা জানেন যে তাদের দর্শকরা অজস্র ভিডিওর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে এবং স্পষ্ট এবং জরুরি আবেগীয় আবেদনই কেবল তাদের থামাতে পারে।

তবে তার মতে, দুঃখের চিত্রে এমন কিছু আছে যা দর্শক এবং বিষয়বস্তুর মধ্যকার সীমানা তুলে দিয়ে একটি বিশেষ সংযোগ তৈরির সুযোগ করে দেয়।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যেমন দুঃখজনক এবং আবেগময় কনটেন্টে প্রতিক্রিয়া জানায়, অ্যালগরিদম ঠিক তেমটিই করে থাকে।

স্যাডবেইট সবসময় দুঃখজনক হয় এমন নয়। সম্প্রতি ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকে স্যাডবেইটের আরেকটি ধরন ভাইরাল হয়েছে। এতে এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) দিয়ে তৈরি বিড়ালদের একটি স্লাইডশোতে দেখানো হৃদয়বিদারক পরিণতি। স্লাইডে বিলি আইলিশের বিষাদময় গান ‘হোয়াট ওয়াজ আই মেইড ফর’ ট্র‌্যাকের ওপর ‘ম্যাও’ শব্দ বসানো হয়েছিল।

এই কনটেন্ট এতো জনপ্রিয় হয় যে গত অক্টোবরে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আইলিশ ওই ‘ম্যাও’ গানটিই পরিবেশন করেন এবং শ্রোতারা আনন্দের সঙ্গে গানটিতে সুর মেলান।

স্যাডবেইটের মাধ্যমে সব সময় বাস্তব অনুভূতিপূর্ণ মানুষদের চিত্রিত করাও প্রয়োজনীয় নয়। ২০২৪ সালের বসন্তে ফেসবুক ফিডে আঘাত পাওয়া অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং দরিদ্র শিশুদের এআই-জেনারেটেড ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যা ওই প্ল্যাটফর্মে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া জানানো পোস্টে পরিণত হয়েছিল।

হ্যারিকেন হেলেনে এক ভুক্তভোগির কাল্পনিক ছবি যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাল হলে ডানপন্থী এক ইনফ্লুয়েন্সার এবং এক রিপাবলিকান রাজনীতিবিদও প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন,ছবিটি মানুষকে নাড়া দিয়েছে তাই এটি ভুয়া হলেও কিছু যায় আসে না। সত্যি-মিথ্যা যাই হোক মানুষ তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে।

অ্যালগরিদম ও দর্শক

অনলাইনে অতি আবেগীয় কন্টেন্ট বিশ্লেষণকারী গবেষকরা মনে করেন, মিথ্যা তথ্য বা মিম যাই হোক, সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্মে তার সফলতা নির্ভর করে দর্শকের এনগেইজমেন্টের ওপরে। যে পোস্টগুলো বেশিবার দেখা, কমেন্ট বা শেয়ার করা হয়েছে সেইগুলো বেশি সংখ্যক লোকের ফিডে পৌঁছে দেয়ার লক্ষেই তাদের অ্যালগরিদমও সেভাবে সেট করা হয়ে থাকে।

একটি পোস্ট যত বেশি মানুষ প্রতিক্রিয়া জানাবে সেটি অন্যের দেখার সম্ভাবনা তত বাড়ায়।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যেসব দুঃখজনক এবং আবেগপূর্ণ বিষয়বস্তুতে সাড়া দেয় অ্যালগরিদমও সেই পোস্টগুলোকে প্রাধান্য দেয়। বড় সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে কনটেন্ট নির্মাতারা তাদের পোস্টের সঙ্গে ব্যবহারকারী কতটা সময় কাটাচ্ছে এবং কতটা গভীরভাবে যুক্ত হচ্ছে তার ভিত্তিতে টাকা পেয়ে থাকে। তাই বেশি সংখ্যক লোকের ফিডে পৌঁছানোর উপায় হচ্ছে অ্যালগরিদমের শর্তপূরণ।

কীভাবে তাদের পোস্ট অনেক বেশি লোকের ফিডে পৌঁছে দিবে নির্মাতারাও সে বিষয়টিতে সচেষ্ট থাকে। আর প্রতিক্রিয়ায় এই চক্রটি চলতেই থাকে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ‘মিথ্যা তথ্য’ বা ফেইক ইনফরমেশন বিষয়ক গবেষক নিনা লুটজ বলেন, ক্রিয়েটররা দর্শক আকর্ষণের জন্য যে কৌশল ব্যবহার করে তা নিয়ে সমালোচনা থাকলেও স্যাডবেইট ভিডিওগুলো শুধু অনুভূতিকে উস্কে দেয় না, সেইসঙ্গে তা অনুভব ও অন্বেষণের পথও দেখায়।

তিনি আরও বলেন, “এটা কনটেন্টের প্রতি প্রতিক্রিয়া বলে আমার মনে হয় না। তারচেয়ে বরং কনটেন্টটি একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা একই রকম আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা থাকা মানুষদের একত্রিত করে।”

টিকটকে এমন অনেক অ্যাকাউন্ট আছে সাদা-কালো ঝাপসা ছবি শেয়ার কলে ক্যাপশন থাকে বিষণ্নতা সম্পর্কে। মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পায় পোস্টগুলো।

যদি আপনার কথা বলার দরকার হয়, ডিএম খোলা রয়েছে প্রোফাইলগুলো এমন কিছু লেখা থাকে। যেখানে অপরিচিতরা তাদের খুব মানবসৃষ্ট সমস্যাগুলি সরাসরি শেয়ার করেন।

লুটজ বলেন, “আমি সেখানে যৌন নির্যাতন, গর্ভপাত, পোলিও, অভিমান, ভাইবোন এবং সন্তান হারানো, একাকীত্ব এবং বিশ্বাসের সংকটের মতো বিষয় নিয়ে মন্তব্য এবং আলোচনা পড়েছি।”

বিষয়গুলো এতো দুঃখজনক যে কয়েকবার কম্পিউটার ছেড়ে উঠে যান বলে জানান তিনি।

অনলাইন সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য পোস্ট করা পুরনো প্রথা উল্লেখ করে লুটজ বলেন, “যখন আমি কিশোর ছিলাম, তখন ফ্যানডম স্পেস বা টাম্বলার মত পাবলিক ফোরামে এমন অনেক কিছু দেখিছি।

“মানুষ একটা সংযোগ খুঁজে আর তা সম্ভবত অপ্রথাগত স্থানে পায়।”

ব্যবহারকারীরা যখন স্যাডবেইট ভিডিওর মন্তব্য ঘরে তাদের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করে তখন ভিডিওটি দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং অ্যালগরিদমকে সক্রিয় রাখে।

কান্নার পাঠ

সোমা বসু জানান, দুঃখ প্রকাশ যেখানে ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত হয়, সেখানে এই ধরনের প্রকাশ বিশেষভাবে উপকারী।

বসু ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অদ্ভুত বিষণ্ণ ধরনের ভিডিও নিয়ে গবেষণা করছেন। ২০২০ সালে ভারতে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার আগে এটি ভাইরাল কনটেন্টে পরিণত হয়। বিষয়টা এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে কীভাবে কান্নার অভিনয় করবে তা শেখানোর জন্য নির্দেশনা দিয়েও ভিডিও বানানো হয়েছিল।

টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার পর এদের অনেকেই ইনস্টাগ্রাম রিলসে স্থানান্তরিত হয়েছেন।

তিনি বলেন,“কান্নার ভিডিওগুলো ভাইরাল হওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত, বিরল গোপন এবং মূল্যবান কিছু দেখার সুযোগ করে দেয়।”

অনলাইনের মানুষরা ব্যারেলে থাকা মাছ নয়: তারা সচেতন ভোক্তা। তার ব্যারেলের পানির স্তর এবং এতে ঝোলানো টোপগুলোকে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করে।

পোস্টগুলোতে ব্যবহারকারীর সাড়া বিদ্রুপাত্মক বা আন্তরিক যাই হোক না কেন অ্যালগরিদম একটা লাইককে লাইকই বুঝে।

তবে ব্যবহারকারী কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারে যে অ্যালগরিদম এবং কনটেন্ট নির্মাতা তাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। পোস্টটি বানোয়াট সেটাও তারা শনাক্ত করতে পারে বলে লুটজ মনে করেন।

ব্যবহারকারীরা গালি দিক বা পছন্দ করুক মূল কথা সাড়া আদায় করে নেওয়া। সংযুক্তি বেশি হলেই তা সফল। অনলাইনে অন্য অনেক কিছুর মতো ‘স্যাডবেইট’ কন্টেন্ট বেশি কার্যকর, কারণ মানুষ দেখতে চায়।

বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন মাহবুবা ডিনা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads