বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি প্রকাশের পর রাজনৈতিক মহলে নতুন করে শুরু হয়েছে আলোচনা- এই ছুটি কি শুধুই প্রশাসনিক, নাকি নেপথ্যে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক অঙ্ক ও কৌশল?
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের ছুটি নিয়ে দুইটি ভিন্ন মত উঠে এসেছে। একটি পক্ষের মতে, ডব্লিউএইচও কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি ও তথ্য গোপনের মামলার কারণে তাকে ছুটিতে পাঠিয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের ভেতরে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ছুটি হতে পারে তার মা শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করার প্রস্তুতির অংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। এতে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি ডব্লিউএইচওতে আঞ্চলিক পরিচালক পদে আবেদনের সময় তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার দাবি করেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে।
এছাড়াও সূচনা ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে বিভিন্ন উৎস থেকে ২.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহের পর তার ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
গত জানুয়ারিতে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা পুতুলের নিয়োগের বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর আগে গত অক্টোবরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়, তারা পুতুলকে বাদ দিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে আগ্রহী। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চিঠি দেওয়ার কথাও জানানো হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে।
চিঠিতে মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ যেন সরাসরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, তাদের যেন পরিচালকের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে না হয়।

এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে সায়মা ওয়াজেদ কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশে ডব্লিউএইচও’র কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছিলেন না।
এর মধ্যেই শুক্রবার সংস্থাটির মহাপরিচালক টেডরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস একটি অভ্যন্তরীণ ইমেইলের মাধ্যমে জানান যে, সায়মা ওয়াজেদ ১১ জুলাই থেকে ছুটিতে যাচ্ছেন এবং তার স্থানে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন ডা. ক্যাথারিনা বোহেম।
নানা মত, নানা ভাষ্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা মনে করছেন, বিষয়টি শুধু মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নয়। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলে আলোচনা চলছিল, কীভাবে দলকে আরো সচল ও পুনর্গঠন করা যায়।
আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা দ্য সান ২৪কে বলেন, “অনেকদিন ধরেই আলোচনায় ছিল পুতুলের সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। কিন্তু আন্তর্জাতিক দায়িত্বের পাশাপাশি তা সম্ভব হতে দিচ্ছিল না। ভেতর থেকেও চাপ ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ যেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাজে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। এখন মনে হচ্ছে পারিবারিক সম্মতিতেই তিনি ছুটিতে গেছেন।”
দলটির আরও দুইজন নেতা যারা বর্তমানে ভারতে আশ্রয়ে আছেন, তারাও ধারণা করছেন, ছুটির পেছনে ডব্লিউএইচও’র সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে।
তারা বলেন, কার্যত এই ছুটির কারণে দলের সাংগঠনিক কাজে তিনি মনযোগী হবেন বলেই আমাদের ধারণা, বিশেষ করে দল পুনর্গঠনের কাজ যখন চলছে।
অবশ্য এর পেছনে আরও কোনো কারণ থেকে থাকতে পারে, যা উপেক্ষা করার উপায় নেই।
মামলার ভিত্তিতে সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তার কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে ডব্লিউএইচওতে তার দায়িত্ব পালন করাই হয়তো হয়ে পড়েছিল অনিরাপদ ও জটিল।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরবর্তী উত্তরাধিকারী কে হবেন?- এ প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের শেষ দিকেও মায়ের সঙ্গে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফরে দেখা গিয়েছে। সেসময় অনেকেই ধারণা করেছিলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হয়তো তাকে রাজনীতির ‘সহজপাঠ’ হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন।
তবে সেসময় ক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
পাশাপাশি তিনি এও বলেছিলেন, “ভবিষ্যতে কে নেতৃত্বে আসবেন সেটি বাংলাদেশের জনগণ ঠিক করবে, আর ঠিক করবে আমার দল। ছেলেমেয়েকে শিক্ষা দিয়েছি। তাদের শিক্ষাটাই একমাত্র সম্পদ। তাদের বলেছি, যে শিক্ষা দিয়েছি, সে শিক্ষা অনুযায়ী দেশের কল্যাণে কাজ করতে।”
প্রায় আড়াই দশক ধরে সাংবাদিকতা করে আসা একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য সান ২৪-এর সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “দেখুন, কোথাও বলা হয়নি ডব্লিউএইচও পুতুলকে ছুটিতে পাঠিয়েছে, নাকি তিনি স্বেচ্ছায় ছুটিতে গিয়েছেন। ছুটিতে পাঠানো হয়ে থাকলে এক ধরনের ভাষ্য, আর নিজ থেকে ছুটি নিয়ে থাকলে আরেক ধরনের।

“আমি ব্যক্তিগতভাবে দুটি বিষয়ের দ্বিতীয়টি নিয়ে প্রথমে কথা বলতে চাই। আমার কাছে যে তথ্য আছে তাতে আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকদিন ধরেই আলোচনা চলছিল ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কে আসবেন? দলটির গুটিকয়েকের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলেও বেশিরভাগ নেতৃত্বই মনে করছিলেন আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রক্তের কেউ ছাড়া বিকল্প নেই। সন্তানদের রাজনীতিতে আনার বিষয়ে শেখ হাসিনার অনীহার কারণে মাঝে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে প্রস্তুত করার চেষ্টা আমরা দেখেছি। আশির দশকে জন্ম নেওয়া রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিককে আওয়ামী লীগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গবেষণা শাখা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টির দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে ওটাই কারণ ছিল। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে তাকে যতোটা মেধাবী বলে ধারণা করা হয়েছিল তিনি তার ধারেকাছেও নন।
“লক্ষ্য করে দেখবেন, ববি ৫ আগস্টের পর থেকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের এই কঠিন সময়ে রেহানার দিকের কেউ হাল ধরতে এগিয়ে আসবেন বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া ববির জনসম্পৃক্ততাও শূন্যের কোটায়।
“এ অবস্থায় জয়কে বাদ দিলে বিকল্প হিসেবে থাকছেন কেবল সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, যার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেমন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তেমনি মায়ের সান্নিধ্যে থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির নানাদিক সম্পর্কেও জানাশোনা আছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
“এসব বিবেচনায় আওয়ামী লীগের বর্তমান দুঃসময়কে মাথায় রেখে শেখ হাসিনা যে তাকে রাজনীতি আনবেন বা আনার চেষ্টা করবেন- সেটাই স্বাভাবিক। সেটা আজ হোক বা কাল।
“এক্ষেত্রে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল স্বেচ্ছায় ছুটিতে গিয়েছেন বলেই আমার ধারণা, বা তিনি কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে মায়ের দলের কাজে হাত লাগাতে চান- এমনটিও অবিশ্বাস্য নয়,” যোগ করেন এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক।
তিনি আরও বলেন, আর যদি তাকে ছুটিতে পাঠিয়ে ডব্লিউএইচও না ফেরানোর পথে হাঁটে তাতেও আমার ধারণা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে শিগগির আমরা রাজনীতিতে দেখবো।”
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ও টেলিভিশনে কাজের অভিজ্ঞতা থাকা এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক এক কথায় ছুটির বিষয়টি “বহুমাত্রিক অর্থ বহন করে” বলেই মনে করছেন।
“একদিকে এটি হতে পারে আন্তর্জাতিক সংস্থার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক পদক্ষেপ, আবার অন্যদিকে এটি হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের এই ছুটি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ঘর গোছানোর চেষ্টায় নতুন মাত্রা যোগ করবে কিনা—তা সময়ই বলে দেবে,” যোগ করেন তিনি।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: