রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে রাষ্ট্রপতির স্থান দেশের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে, সংবিধানেই তা লেখা আছে; কিন্তু তার ক্ষমতার দৌড় আসলে কতটুকু, তা স্পষ্ট হয়ে গেল এবারের বিজয় দিবসের বাণীতে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে ২০২৪ সালের বিজয়ী দিবসে যে বাণী এসেছে, তার সঙ্গে ২০২৩ সালের বাণীর অনেক বাক্য গঠনে অনেক মিল পাওয়া গেলেও ফারাকও চোখে পড়ার মতো।
রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যাওয়ার পর এবারের বাণীতে নেই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম, নেই একাত্তরে যাদের সঙ্গে বাঙালি লড়াই করে মুক্তি ছিনিয়ে এনেছে, সেই পাকিস্তানি বাহিনীর কথাও।
অথচ, ২০২৩ সালে বিজয় দিবসের বাণীর শুরুতেই ছিল বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে। ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের কথা। তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে সর্বোচ্চ স্থানে থাকলেও সংিবধান রাষ্ট্রপতিকে বেশি ক্ষমতা দেয়নি। সংবিধানে লেখা আছে- প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।
বর্তমানে সাংবিধানিক সংকটের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেই রাষ্ট্রপতির এই বাণী এসেছে বলে ধরে নেওয়া চলে।
কেননা মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আনুগত্যকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
সাহাবুদ্দিন বিচারক জীবন শুরুর আগে আওয়ামী লীগে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে জেল খেটেছিলেন। জজ হিসাবে অবসর নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের শাসনকালেই দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হন তিনি। পরে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হয়ে এমপি হতেও চেয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে পরে ভুগতে হওয়ার কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন সময় বলেছিলেন। কারণ শেখ হাসিনার তখনকার সরকারের সঙ্গে মতভিন্নতা থাকলে তা জানাতে কসুর করতেন না তিনি। বিভিন্ন বক্তব্যও নিজের মতো করে দিতে চাইতেন তিনি।
সেই রকম পরিস্থিতি এড়াতে মো. জিল্লুর রহমান ও মো. আবদুল হামিদের পর রাষ্ট্রপতি পদে অনুগত বিবেচনায় সাহাবুদ্দিনই হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনার পছন্দ।
কিন্তু তার অবস্থাও হলো বিএনপি সরকার আমলে নির্বাচিত মো. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তাকে দেখতে হয়েছিল, তার নিয়োগকর্তা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বন্দি হতে।
এবার গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর সাহাবুদ্দিন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শপথ করালেও চাপমুক্ত ছিলেন না।
তার পদত্যাগের দাবি তোলে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা; বঙ্গভবনের সামনে নানা কর্মসূচিও পালিত হয়। তবে আরও বড় সাংবিধানিক শূন্যতার আশঙ্কায় বিভিন্ন দল তাতে সমর্থন না দেওয়ায় টিকে যান সাহাবুদ্দিন।
এখন বঙ্গভবনে থাকলেও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা ছাত্র নেতৃত্বের পছন্দের সরকার প্রধান ড. ইউনূসের পরামর্শ মেনেই চলতে হচ্ছে তাকে।
যেকারণে মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিনের বিজয় দিবসের বাণীতেও এক বছরের মধে দেখা দিয়েছে বড় পরিবর্তন।
কোথায় কোথায় ফারাক
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের বিজয় দিবসে রাষ্ট্রপতির বাণীতে ছিল- “আমি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থক, বিদেশি বন্ধু, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণকে, যারা আমাদের বিজয় অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন।”
সেখানে ২০২৪ সালের বাণীর শুরুটা এমন- “বিজয়ের এই দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহিদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি সকল জাতীয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা দুই লক্ষ মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-সমর্থক, বিদেশি বন্ধু, যুদ্ধাহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণকে, যারা আমাদের বিজয় অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। আমি আরও স্মরণ করি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরকে। জাতি তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।”
অর্থাৎ বাণীর ভাষা প্রায় এক। শুধু বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার কথা বাদ পড়েছে। সেখানে যুক্ত হয়েছে জুলাই আন্দোলনের কথা।
গতবারের বাণীতে ছিল- “বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। তবে এ অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল, দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। তারই নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনায় পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।”
এবারের বাণীতে রয়েছে- “স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে এ অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পায়। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়।”
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখানেও বাক্যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। শুধু বঙ্গবন্ধূর নামটি বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাদ দেওয়া হয়েছে পাক হানাদার বাহিনীর নাম।
গত বারের বাণীতে স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর সরকারের কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কথাও ছিল। রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সদ্যস্বাধীন দেশে ফিরে জাতির পিতা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ডাক দিয়েছিলেন কৃষি বিপ্লবের। আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, লুটেরাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্রের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ তার পরিবারের আপনজনদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে উন্নয়নের সেই অভিযাত্রা থমকে দাঁড়ায়। রুদ্ধ হয় গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথ। উত্থান ঘটে স্বৈরশাসন ও অগণতান্ত্রিক সরকারের।”
এবারের বাণীতে রয়েছে- “আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম ও কৃষি বিপ্লবের শুরু হয়। কিন্তু বিজয়ের পাঁচ দশক পার হলেও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনও অর্জিত হয়নি। বার-বার আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথচলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।”
পররাষ্ট্র নীতির কথা বলতে গিয়ে গতবার বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন – “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতা ঘোষিত এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। যুদ্ধ কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। বাংলাদেশ মনে করে, আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।”
এবারের বাণী হয়েছে এমন- “বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাসী। যুদ্ধ কোনও দেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। বাংলাদেশ মনে করে, আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।”
গতবারের বাণীতে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ প্রশংসা করে বলা হয়েছিল- “আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১’ সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।”
এবারের বাণীতে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেছেন, “এ বছর জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন এ দেশের মানুষ দেখেছে, তা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে বলে আমি মনে করি।”
গত বারের বাণীতে রাষ্ট্রপতি আহ্বান রেখেছিলেন- “আসুন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখি, দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ এবং প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।”
এবারের বাণীতে তিনি বলেছেন- “আসুন, ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখি। দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি উন্নত-সমৃদ্ধ এক নতুন বাংলাদেশ।”