এবার আক্রান্ত ভাস্কর রাশা, সমালোচনার ঝড়

ভাস্কর রাশা।
ভাস্কর রাশা।

হত্যাচেষ্টায় জড়িত মামুনুর রশীদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, চঞ্চল চৌধুরী, রিয়াজ, ফেরদৌস, অপু বিশ্বাস! ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, মামলা হয়েছে। আসামির তালিকায় তাদের সঙ্গে শমী কায়সার, রোকেয়া প্রাচী, সাজু খাদেম, নিপুণ, জায়েদ খান, মেহের আফরোজ শাওনের নামও রয়েছে। তার মধ্যে আবার অভিনেতা সিদ্দিককে ধরে প্রকাশ্যে মারধরের পর থানায় তুলে দেওয়া হয়েছে।

অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে শিল্পী সমাজ যখন নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, তখন আক্রান্ত হলেন ভাস্কর রাশাও। ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে গুলশানের সড়কে তাকে অপদস্থ করা হয়েছে।

সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়; তা দেখে ক্ষোভ জানাচ্ছেন শিল্পী-সাহিত্যিকসহ অনেকেই। যে অভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, তার প্রতি ইঙ্গিত করে ফেইসবুকে মন্তব্য আসছে- “যখন যাকে যেভাবে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করতে পারার নামই বোধহয় স্বাধীনতা।”

ভিডিওটিতে দেখা যায়, রাশা রিকশায় যাচ্ছিলেন। এক যুবক রিকশা থামিয়ে তাকে বলছেন, “আপনার নামে মামলা হয় নাই? আপনি কই যান? গুলশান থানায় চলেন। আপনি কী করেছেন, জানেন না? খালেদা জিয়ার বাসায় অবরোধ করেন নাই। চলেন, থানায় চলেন।”

রাশা তখন ‘না না, আমি না’ বলে রিকশা থেকে নেমে চলে যেতে চাইলে ওই যুবক প্রথমে অশালীন ভাষায় গালাগালি করেন রাশাকে। তারপর পেছন থেকে লাথি মারেন। রাশা পড়তে পড়তে কোনো রকমে সামলে ওঠেন।

ঘটনাটি সোমবার গুলশানে ঘটেছে বলে সমকাল খবর নিয়ে জানিয়েছেন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ধ্যায় ভাস্কর রাশা রিকশায় গুলশান সাজু আর্ট গ্যালারিতে যাচ্ছিলেন। গুলশান ১ ও ২ এর মাঝামাঝি স্থানে ওই যুবক তাকে আটকায়।

এই ঘটনার পর রাশা মাননিকভাবে ভেঙে পড়েছেন বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। থানায় অভিযোগও দেননি।

সোমবার গুলশানে লাঞ্ছিত করা হয় ভাস্কর রাশাকে, যিনি ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

সমকাল ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার তারেক মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ভিডিওটি তারা দেখে ভাস্কর রাশাকে হেনস্তার ঘটনাস্থল চিহ্নিত ও জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।

ভাস্কর রাশাকে অপদস্থকারীর নাম মেহেদী বলে সোশাল মিডিয়ায় অনেকে জানাচ্ছেন। কেউ বলছেন, তিনি বিএনপির কর্মী, কেউ বলছেন জামায়াতে ইসলামীর।

শিল্পীদের মধ্যে প্রতিবাদী মুখ ভাস্কর রাশা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যেমন বানিয়েছেন, তেমনি ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গুলশানে দলটির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তার তৈরি জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যি খনও শোভা পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে রাজপথেও দাঁড়াতে দেখা গেছে তাকে।

সেই রাশার ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে চিত্রশিল্পী চারু পিন্টু ফেইসবুকে লিখেছেন, “রাশা ভাই নিরীহ মানুষ। তার উপর এমন আক্রমণ এটা কোনোভাবে মেনে নেয়া যাবে না।

“অসত্য বা অসুন্দরের বিরুদ্ধে শিল্পীরা সবসময় তার কর্মে বিরুদ্ধতা করবে এটা সব শিল্পীর স্বভাব। তার মানে এই নয় যে রাস্তাঘাটে এরকম মব সৃষ্টি করবেন। নানান কাল্পনিক গল্প বানিয়ে মব উস্কে দেবেন। এই স্বভাব থেকে বের হন। মানুষের বিপরীতে অবস্থান করে আপনারা মানুষের পক্ষে থাকতে পারবেন না। পলিটিক্যাল কনসেপ্ট পাল্টান।”

কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার হতাশার সুরে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন- “ভাস্কর রাশা আমাদের মতো পোড়া দেশে শত বছরে একজন জন্ম নেন। আর দলগুলোর ক্যাডাররা জন্ম নেয় পোকা-মাকড়ের মতো লাখে লাখে। বিষাক্ত পোকা-পতঙ্গের এই দেশে রাশা অনাকাঙ্ক্ষিত, এটাই স্বাভাবিক।”

কার্টুনের জন্য আওয়ামী লীগ আমলে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশছাড়া হওয়া শিল্পী আহমেদ কবীর কিশোর ভাস্কর রাশার ওপর হামলার ঘটনায় ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

রাশার ভাস্কর্যশিল্পী হয়ে ওঠার পাশাপাশি তার প্রতিবাদী চরিত্র তুলে ধরে কিশোর ফেইসবুকে লিখেছেন, “এরশাদের শাসনামলে কালচারাল কমিশন একটা আইন করেছিল যে ৬০টা শিল্পকর্ম না হলে একজন শিল্পী জাতীয় চিত্রশালায় প্রদর্শনী করতে পারবে না। শিল্পকলা একাডেমির এই আইনের প্রতিবাদে ১৯৮৭ সালে তিনি চারটা ভাস্কর্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। পরে শিল্পকলা একাডেমি তার প্রদর্শনী করতে বাধ্য হয়।”

রাশার সঙ্গেড় ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার রাজনীতি সচেতন শিল্পী সত্তার খোঁজ পেয়েছিলেন কিশোর। তিনি লিখেছেন, “শিল্পী যদি রাজনীতি সচেতন না হয়, সে শিল্পী জনমানুষের না। কখনোই না।”

শেখ হাসিনা অনুগ্রহ নিয়ে বহু শিল্পী আখের গুছিয়ে নিলেও রাশা সেই দলে ভিড়তে চাননি বলেই কিছু পাননি বলে মনে করেন কিশোর।

তিনি লিখেছেন, “রাশা ভাই এর শার্টের পকেটে ধারালো স্প্যাচুলা থাকতে দেখেছি। মগবাজারের বাসায় ফিরতে রাতে-বিরাতে ছিনতাইকারীর খপ্পর থেকে বাঁচতে ভাস্কর্যের এই ছোট্ট উপকরণ তাকে সাহস যোগাত।

“যে রাশা ভাই এরশাদের মতো স্বৈরাচারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেই রাশাভাই তার বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে পিঠে লাথি খেয়ে পালিয়ে গেল নিমিষে। তার পকেটে কি আজকাল স্প্যাচুলাটা থাকে না?”

ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা জাহিদুল ইসলাম সজীব ২০১৮ সালে শাহবাগে এক প্রতিবাদী কর্মর্সূচিতে রাশার ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, “২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ের ছবি। আমি লাইভ করেছিলাম কর্মসূচিটা। আনু স্যারের (আনু মুহাম্মদ) পাশে দাঁড়ানো ভাস্কর রাশা।

“গতকাল উনাকে মব করছে। যাইহোক, ঘটনা হইলো, ফাররাইটদেরকে নরমালাইজ করার ও লেজিটিমাইজ করার যে পাপ আমরা করছি, সেটার ফল এই দুনিয়াতেই আমরা ভোগ করছি।”

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ের ছবি, যেখানে আনু মুহাম্মদের পাশে দাঁড়ানো ভাস্কর রাশা।

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মাহমুদা খা ভাস্কর রাশার ওপর হামলাকারী যুবককে জামায়াত সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে লিখেছেন, “এই জামাতি গণ ভবন এবং সংসদ ভবন লুটেরাদেরও একজন।

“জামাতপন্থী, নব্য গঠিত কথিত ‘কিংস পার্টি’ (এনসিপি), এমনকি ছাত্রদলের ক্যাডাররা জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীদের/সমর্থকদের অপমান করছে। লীগ সমর্থক হলেই তারে এভাবে লাথি দিতে হিবে, আঘাত করতে হবে! এরা তাকে ধরে অপমান অপদস্থ করার যে সংস্কৃতি চালু হরেছে , তাতে প্রশ্ন জাগে এর পেছনে কার নির্দেশনা রয়েছে? যাদের দায়িত্ব ছিল নেতৃত্ব দেওয়া, তারা কি জানেন না, কে কোথায় কী করছে? নাকি তারা নিজেরাই এদের পেছনে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছেন? ইউনুস সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন রেখে গেলাম এভাবে আর কত দিন চলবে?”

ভাস্কর রাশার জন্ম কুমিল্লায়; তিনি ১৯৮১ সলে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) থেকে ভাস্কর্যে ডিপ্লোমায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। গত শতকের আশির দশকে সেগুন কাঠের ভাস্কর্য গড়ে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেণ। অসাধারণ সেই কাজে ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় এশিয়ান বিয়েনালে গ্রান্ড প্রাইজ অর্জন করেন। জাতীয় জাদুঘরেও রয়েছে তার কাঠের ভাস্কর্য।

১৯৯৭ সালে রাশার শকুনের প্রতিকৃতির প্রসঙ্গ ধরে এক প্রবাসী ফেইসবুকে লিখেছেন- মানবরূপী শকুনিদের কাজের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে তিনি থাকেন।

“আজ যেন দেখলাম প্রগতিকে ধাক্কা খেতে! আজ ভাস্কর রাশাকে লাঞ্ছিত হতে দেখে আমার জাতির ব্যাপারে লজ্জিত হলাম।”

শিল্পীদের ওপর হামলা-মামলার পর অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম বলেছেন, “মামলা করে দিলেন এবং তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা শুরু করলেন, এই প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে, এটাই যদি আমাদের মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে বিভক্তি আরও বাড়বে।”

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক শিল্পীকে এই দলটির কাছাকাছি থাকতে দেখা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আজাদ আবুল কালাম বলেন, “শিল্পীরা হয়তো কখনো কখনো সরকারের পক্ষে কথা বলেছে। সেখানে তার রাজনৈতিক একটা পরিচয় থাকতেই পারে। তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা থাকতেই পারে। এরা কিন্তু সরিও বলেছে।

“বেশির ভাগকেই দেখেছি, গণ-অভ্যুত্থানের সময় ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, মানুষের পক্ষে কথা বলেছে। শিল্পীরা তো স্বাভাবিকভাবে মানুষের পক্ষে কাজ করা মানুষ। শিল্পীদের এভাবে ঢালাওভাবে মামলায় ফেলে, একের পর এক মামলা দিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা এবং তাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার চাদরে মুড়ে দেওয়া, এটা অদ্ভুত রকমের সংস্কৃতি।”

আরও পড়ুন