আগের দিন রাতে হঠাৎ করে মুহাম্মমদ ইউনূসের সরকারি বাড়ির সামনে শুরু হওয়া অবস্থান কর্মসূচি স্থান ও নাম পরিবর্তন করে শুক্রবার হয়েছে ‘শাহবাগ ব্লকেড’, যা সাজানো হয়েছে অনেকটা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের আদলে। এক যুগের ব্যবধানে প্রেক্ষাপট যেমন ভিন্ন, তেমনি ভিন্নতা রয়েছে বিক্ষোভকারীদের দর্শনেও।
ক্ষমতার পালাবদলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দেশের সবচেয়ে পুরনো দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানাতে জড়ো হওয়াদের সঙ্গে সোচ্চার রয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির ছাড়াও তাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সংগঠন।
প্রথম আলো লিখেছে, তাদের প্রতিবেদক শুক্রবার রাতে সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন, শাহবাগ মোড় বন্ধ করে আন্দোলনকারীরা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। তাদের সবার স্লোগানের মূল বিষয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
শাহবাগ চত্বরে বিজ্ঞাপন বোর্ডের নিচে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা।
এ ছাড়া ইসলামী ছাত্রশিবির, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরাও আলাদা আলাদাভাবে জড়ো হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন।
নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানী ও তার কিছু অনুসারীকেও অবস্থান নিতে দেখা গেছে বলে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তারাও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানাতে সেখানে জড়ো হয়েছেন।
দ্য সান ২৪-এর ঢাকা প্রতিবেদক জানিয়েছেন, দিনব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের হাতে জাতীয় পতাকাসহ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি–সংবলিত নানা পোস্টার তিনি দেখেছেন। স্লোগানের মূল বিষয়ই ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি: ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’, ‘এই মুহূর্তে ব্যান চাই, আওয়ামী লীগের ব্যান চাই’, ‘আবু সাইদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জুলাইয়ের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’সহ বিভিন্ন স্লোগান।
এদিকে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে “দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত না এলে সমগ্র বাংলাদেশ আবারো ঢাকা শহরে মার্চ করবে” জানিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি তিন দফা দাবি তুলে ধরেন।
এর মধ্যে রয়েছে, আওয়ামী লীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আওয়ামী লীগের দলগত বিচারের বিধান যুক্ত করা, এবং জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করার দাবি।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে “বাংলাদেশপন্থি” সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ এনসিপির এই নেতা।

এর আগে রাত ৯টার দিকে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম শাহবাগ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না। শাহবাগেই আওয়ামী লীগের কবর খুঁড়ব।”
সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে এনসিপির এই নেতা বলেন, “আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তী সরকার) দেরি করলে শুধু শাহবাগ নয়, সারা বাংলা ব্লকেড দেব।“
এ সময় জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
এরপর রাত ১টার দিকে একই দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ শাহবাগ মোড়ে চলমান অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন বলেন, “অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি ২৫ ঘণ্টা হয়েছে। আমরা জানি না এ কর্মসূচির শেষ কোথায়। যতক্ষণ না পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ তিন দফা দাবিতে শনিবার বিকেলে শাহবাগে গণজমায়েতের ঘোষণার পাশাপাশি সারা দেশে জুলাই অভ্যুত্থানের পয়েন্টগুলোতে গণজমায়েত করার আহ্বান জানান এই এনসিপি নেতা।
সরকার কী বলছে
যমুনার সামনে বিক্ষোভের মধ্যেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে বিৃবতি দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূসের সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া বিবৃতিতে সরকারের অবস্থান জানিয়ে বলা হয়েছে, “সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।”
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “এ ব্যাপারে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন সরকার বিবেচনায় রাখছে।”
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনে নামা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধারণ করার আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
একইসঙ্গে বিবৃতিতে জনদাবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে “প্রচলিত আইনের অধীনে” ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া, সরকারের পক্ষে থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।
পাশাপাশি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার ঘটনার সঙ্গে “জড়িত সকলের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর” বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
সমাবেশে শীতল পানির পরশ
এর আগে দুপুরে সমাবেশ শুরুর পর আন্দোলনকারীদের স্বস্তি দিতে ঠাণ্ডা পানি ছিটানোর বন্দোবস্ত করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে সেখানে সরবরাহ করা হয় খাবার পানি।

যমুনার পাশে পাঁচতারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে যে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল সেখানে ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতাদের বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। এনসিপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, ছাত্র শিবির ও ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরাও সেখানে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
মাহফুজের পোস্টের পর আবার কী হচ্ছে?
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এনসিপি-শিবির-হেফাজতের শাহবাগ অবরোধ