আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া আদালত অবমাননার রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ভার্চুয়ালি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
ভাষণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, বিচার ব্যবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
একইসঙ্গে বর্তমান সরকারের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভাষণের একটি বড় অংশ জুড়ে তিনি বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সরাসরি আক্রমণ দাগান। পাশাপাশি তাকে ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
আদালত অবমাননার অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি নাকি আদালতের অবমাননা করেছি! আরে আদালত কই যে অবমাননা করবো। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী, তাদের আবার অবমাননা।”
শেখ হাসিনা প্রশ্ন রাখেন, “বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় আদৌ কি আদালত অবমাননার সাজা দেওয়ার এখতিয়ার আছে?”
গত ৩ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
চরম বেহায়া ইউনূস
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তার মান সন্মান আছে নাকি। আত্মসম্মান বোধ আছে? কিছুই নাই। চরম বেহায়ার মতো ক্ষমতায় বসে আছে। লজ্জা শরম নাই।”
“তার নিজের কোম্পানির লেবারদের টাকা চুরি করে খেয়েছে। সেই লেবাররা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। লেবার কোর্টে সে ছয় মাসের সাজাও পেয়েছিল।”
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে চব্বিশের তুলনা করা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, এখন বলে কি মুক্তিযুদ্ধও নাকি মেটিকুলাসলি ডিজাইনড! ওই মুক্তিযুদ্ধের সাথে এই জঙ্গিদের নিয়ে ক্ষমতা দখলের তুলনা হয় না। আর এত ধৃষ্টতা কোথায় পায় এভাবে তুলনা করে? তুলনার অধিকার আছে তাদের?
মামলা মোকাবেলা করব
নিজের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “এখন তো আমার নামে বোধহয় মামলা প্রায় সাড়ে চারশ। তার মধ্যে চারশ চল্লিশটার মতো খুনের মামলা। আজকে যারাই দেশ শাসন করে, তাদের শাসন করার কোন অধিকার নাই। অন্যায়ভাবে অবৈধভাবে জঙ্গিদের দিয়ে দেশ দখল করেছে। এই দেশ আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। আর তাকে অপমান করা হয়। অবমাননা করা হয়। আর আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়।
“এই ইউনূস একটা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী। তার প্রত্যেকটা হুকুম প্রত্যেকটা অর্ডার অবৈধ। তাদের দেশ চালাবার কোন বৈধতা নাই। অস্ত্র হাতে নিয়ে জঙ্গিদের ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।
“হ্যাঁ, ঠিক আছে। মামলায় হাজিরা তো আমাকে দিতেই হবে। আমি আসবো, নিশ্চয়ই আসবো। মামলা মোকাবেলা করব। দেখি কত ধানে কত চাল। বাংলাদেশটা আমাদের। জনগণের। আর জনগণই আমার শক্তি।”
আইন সংশোধন নিয়ে প্রশ্ন
শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলেন, “আইসিটির মূল যে আইন, সেই আইন এক্সিকিউটিভ অর্ডারে সংশোধন করেছে। সংশোধন করবার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? আজকে চিফ প্রসিকিউটর এবং যারা এই উপদেষ্টা পরিষদে আছে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল থেকে শুরু করে ইউনূসকে আমি জিজ্ঞাসা করি- তাদের কী লিগ্যাল রাইট আছে?”
নারী নির্যাতন নিয়ে ক্ষোভ
সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন, “আজকে নির্যাতন চরম আকারে পৌঁছেছে। কোনও মেয়ের কোনও অধিকার নাই। কত বড় জঘন্য এরা। এরা বিএনপি করে, জামায়াত-শিবির করে, আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে… আর এইভাবে মেয়েদেরকে উলঙ্গ করা, মেয়েদেরকে র্যাপ করা, মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা- তাদের ঘরে মা-বোন নাই?”
ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে ক্ষোভ
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “মেট্রোরেলে আগুন, এক্সপ্রেসওয়েতে আগুন, পুলিশকে মারা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা… যারা এসব হত্যাকাণ্ড করল, তাদেরকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দায়মুক্তি দিয়ে একটা কাজ ভাল করেছে! এটা তো এভিডেন্স, অপরাধী না হলে দায়মুক্তি দেবে কেন?”
“এই ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে যত হত্যাকাণ্ড এবং যত জ্বালাও পোড়াও হয়েছে সবকিছুর জন্য তাদেরকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।”
জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গ
একাত্তরে জামায়াত নেতাকর্মীদের কুকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, “সেসময় সবকিছুর সাথে এরা জড়িত ছিল। পরে বয়সটা বেড়েছে; সুন্দর দাড়িটারি হয়েছে এবং নূরানি চেহারা হয়েছে। কিন্তু এই চেহারা তখন ছিল না… পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে হাত মিলিয়ে গ্রামের পর গ্রাম তাদেরকে পথ দেখিয়ে গেছে।”
গণগ্রেপ্তার ও কারাভোগের অভিযোগ
তিনি বলেন, “আজকে প্রায় সাড়ে চার লাখ আমাদের নেতাকর্মী কারাগারে। প্রতিনিয়ত কারাগারে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। অস্ত্র হাতে নিয়ে জঙ্গিদের ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।”
দেশ রক্ষার আহ্বান
শেখ হাসিনা বলেন, “অর্থনীতি ধ্বংস, রাজনীতির ধ্বংস, সাংস্কৃতিক অবস্থান ধ্বংস, সামাজিক নিরাপত্তা ধ্বংস—সমস্ত দেশটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে সাথে নিয়েই পথে নামতে হবে।”
“আমি আছি, সব ধরনের সহযোগিতা আমি করে যাব। কিন্তু আমাদের দেশটাকে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে।”
ভারতে অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, একটা সুবিধা হয়েছে, এখানে আছি বলে কথা বলতে পারছি। ২০০০ সালে জোর করে দেশে ফিরেছিলাম। এরপর তো বন্দি করে রেখেছিল, আর কথা বলতে পারিনি। কিন্তু এবার বাইরে থেকে সবার সঙ্গে কথা বলতে পারছি।”
মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সরকারের অধীনে বাংলাদেশ ও এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
বক্তব্যে ‘মব জাস্টিসের’ নামে নিপীড়ণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এটা মব জাস্টিস না, এটা হল মব সন্ত্রাস। সে (ইউনূস) সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে।”