শেখ হাসিনার বিচারের সঙ্গে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ কী সম্পর্ক

প্রতীকী ছবি। দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকম।
প্রতীকী ছবি। দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বাংলাদেশের “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে” চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে শেখ হাসিনা আখ্যায়িত করেছেন ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ হিসেবে। এ নিয়ে জাতিসংঘে আইনজীবীর মাধ্যমে নালিশও জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগ তুলেছেন, তার অনুপস্থিতে যেভাবে বিচার চলছে তা দেখে স্পষ্ট অনুমান করা যায়- এই আদালতে ‘রায় পূর্বনির্ধারিত’।

প্রশ্ন হলো- অস্ট্রেলিয়ার মারসুপিয়াল প্রাণী ক্যাঙ্গারুর সঙ্গে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কিংবা রাজনীতির সম্পর্কই বা এলো কোথা থেকে? কেনই বা ট্রাইব্যুনালের ‘বিচারপ্রক্রিয়ায়’ ক্যাঙ্গারুর ছায়া মিলছে।

অনেকে মনে করতে পারেন “ক্যাঙ্গারু কোর্ট” শব্দটির উৎস অস্ট্রেলিয়ায়। বাস্তবে এর উৎস ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার, গোল্ড রাশ আমলে।

ছয়বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প কংগ্রেসে তার বিরুদ্ধে হওয়া অভিশংসন তদন্তকেও “ক্যাঙ্গারু কোর্ট” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

ক্যাঙ্গারু কোর্ট কী

যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য ‘কর্নেল ল স্কুলের’ ব্যাখ্যায় এই প্রবাদ-প্রতিম ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ শব্দের দুটি উৎসের খোঁজ মেলে।

সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটি অনেকটা এরকম- সেসময় সীমান্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো বিচারকদের আচরণ থেকে এই শব্দের জন্ম, যাদের এক শহর থেকে আরেক শহরে “লাফিয়ে লাফিয়ে” যাওয়া এবং তাড়াহুড়ো করে অন্যায্য রায় দেওয়ার সুখ্যাতি ছিল।

দ্বিতীয়টি স্বর্ণখনি অঞ্চলে “ক্লেইম জাম্পিং’ বা অন্যের খনি দখলের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যের জমিতে বেআইনিভাবে খনন করার বিরোধ নিস্পত্তিতে দ্রুত ও অনানুষ্ঠানিক আদালত থেকে এই শব্দের সৃষ্টি। এসব আদালতে নজরদারি তেমন ছিল না, আর বিচার হতো ‘দ্রুত গতিতে’।

তার মানে “ক্যাঙ্গারু কোর্ট”, এমন আদালত বা বিচারপ্রক্রিয়াকে বোঝায় যেখানে আইনগত নিয়ম-কানুন এতটাই লঙ্ঘিত হয় যে বিচার আর ন্যায়সঙ্গত বা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। এটি অত্যন্ত কঠোর অভিযোগ, যা সাধারণত কেবলমাত্র ভয়াবহ বিচার বিভ্রাট বা বিচারকের চরম অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

শুধু অযোগ্যতা বা দুর্বল বিচারমানই সাধারণত “ক্যাঙ্গারু কোর্ট” আখ্যা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। যে ধরনের অনিয়মের কারণে কোনো আদালতকে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বলা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • আদালত কোনো এক পক্ষের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত দেখানো
  • বিচারক ও কোনো পক্ষের মধ্যে যোগসাজশ থাকা
  • অভিযুক্তের ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার লঙ্ঘন হওয়া
  • বিচার অত্যধিক তাড়াহুড়ো করে সম্পন্ন হওয়া, যাতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না
  • নিরপেক্ষ জুরি না থাকা
  • বিচারপ্রক্রিয়ায় শৃঙ্খলা ও শালীনতার অভাব
  • আইনের এমন ব্যাখ্যা দেওয়া যা কোনো পক্ষকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়

যদিও এই শব্দটি যে কোনো পক্ষের প্রতি অন্যায়ের বর্ণনায় ব্যবহার করা যেতে পারে, তবু সাধারণত এটি ব্যবহৃত হয় অভিযুক্তের প্রতি অযথা শাস্তি দেওয়া বা দেওয়ানি মামলায় বাদীর পক্ষেও অযৌক্তিকভাবে রায় দেওয়ার প্রসঙ্গে।

আওয়ামী লীগ কী বলছে

ক্যাঙ্গারু কোর্টের ব্যাখ্যায় যেমনটি বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শেখ হাসিনার মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় এরকম বেশ কয়েকটি গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে দলটি।

আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্ত অভিযোগ হলো- শেখ হাসিনাকে নিজের পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দলটির দাবি, ট্রাইব্যুনাল বা রাষ্ট্র নিজেদের পছন্দমতো বিবাদী পক্ষের আইনজীবী নিয়োগ করেছে। এসব আইনজীবীর নিয়োগে আসামি শেখ হাসিনার সম্মতি নেওয়া হয়নি।

এটি একটি বৈশ্বিক নীতির লঙ্ঘন। যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির নিজের আইনজীবী বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেও অভিযোগ করছেন, তার পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য পছন্দ মতো আইনজীবী নিয়োগে আদালতে আবেদন করা হলেও তা গ্রহণ করা হয়নি।

শেখ হাসিনার পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা লড়তে আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তবে, আদালত তা খারিজ করে দেয়।

এছাড়া আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টাও হয়েছে। তবে সেই চেষ্টাও কার্যত বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ বলছে, মামলাটি পরিচালিত হচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুততায় এবং প্রস্তুতির জন্য আসামিপক্ষকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি। জেরা ও প্রতিরক্ষার সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। বিবাদীপক্ষের আবেদনগুলো দ্রুততার সঙ্গে খারিজ করা হয়েছে।

যদিও রাষ্ট্রপক্ষে করা আবেদনের ক্ষেত্রে আদালত অতিরিক্ত সহনশীলতা দেখিয়েছে। শেখ হাসিনার ব্রিটিশ আইনজীবীদের দাবি, এসবই প্রমাণ করে যে ট্রাইব্যুনাল রায় আগেই নির্ধারণ করে রেখেছে; বিচার-প্রক্রিয়া শুধুই লোক দেখানো।

দলটির মতে, ট্রাইব্যুনালের ওপর রাজনৈতিক চাপ রয়েছে এবং বিচার প্রক্রিয়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা বিচারটিকে একটি রাজনৈতিক ট্রাইব্যুনাল হিসেবে তুলে ধরেছেন।

গেল বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ওই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ১৭ নভেম্বর সোমবার রায় শোনাবে আদালত।
 
বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার রায়ের দিন ধার্য করে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন