আওয়ামী লীগ আমলে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে নিয়োগ পেয়ে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন মোট ৮২৩ জন। ক্ষমতার পালাবদলের পর এখন একে একে চাকরি যাচ্ছে তাদের।
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিএনপি পুলিশে এই নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেছিল, এই এসআইদের দলীয় ও আঞ্চলিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
এরপর নিয়োগ বাতিলের প্রক্রিয়া শুরুর পর বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ থেকে অভিযোগ করা হয়, বেছে বেছে সংখ্যালঘুদেরই বাদ দেওয়া হচ্ছে।
গত অক্টোবর থেকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হচ্ছে প্রশিক্ষণার্থী এসআইদের। সর্বশেষ বুধবার আটজনকে অব্যাহতি দেওয়ার খবর দিয়েছে প্রথম আলো।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আট এসআইর হাতে বুধবার সন্ধ্যায় অব্যাহতিপত্র ধরিয়ে দিয়ে রাত ৯টার মধ্যে তাদের একাডেমি ছাড়তে বলা হয়।
তাদের অব্যাহতি দেওয়ার কারণ দেখানো হয়েছে, রোববার সন্ধ্যায় মাঠে উচ্চ স্বরে হৈ চৈ করা। প্রথমে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছিল। এখন অব্যাহতি দেওয়া হলো।
পুলিশের চাকরিতে নির্বাচিত হওয়ার পর চূড়ান্ত নিয়োগ পাওয়ার আগে সারদার বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেই প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হলেই নিয়োগ মেলে।
ছিল কত? রইল কত?
৪০তম ক্যাডেট এসআই ব্যাচে প্রশিক্ষণের জন্য মোট ৮২৩ জন ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তাদের নির্বাচিত করে প্রশিক্ষণের জন্য সারদায় পাঠােনা হয়েছিল।
গত বছরের ৪ নভেম্বর তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। প্রথম ধাপে কয়েকজন বাদ পড়ার পর প্রশিক্ষণে ছিল ৮০৩ জন।
তাদের মধ্যে এর আগে তিন ধাপে ৩১৩ জন এসআইকে মাঠে ও ক্লাসে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ তুলে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এর মধ্যে গত ২১ অক্টোবর ২৫২ জন, ৪ নভেম্বর ৫৮ জন ও সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর ৩ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এবার চতুর্থ ধাপে আরও আটজনকে বাদ দেওয়া হলো।
ফলে এই ব্যাচে প্রশিক্ষণার্থী এসআই থাকল আর ৪৮২ জন। যদি নতুন করে আর কেউ বাদ না পড়ে, তবে তারা এসআই হিসাবে চাকরি শুরু করতে পারবেন।
সারদার কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা ভঙ্গকে অব্যাহতি দেওয়ার কারণ হিসাবে দেখালেও তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কারণ একাডেমির এক প্রশিক্ষকই বলেছেন, তার ক্লাসে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো কারণ ঘটেনি।
সারদার পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে, অব্যাহতি দেওয়ার আসল কারণ ভিন্ন। যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় বা দলীয় সুপারিশে চাকরি পেয়েছেন কিংবা নিয়োগের সময় আর্থিক লেনদেন জড়িত ছিলেন, তাদেরই বেছে বেছে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের ব্যাপক অভিযোগ ছিল। পুলিশে নিয়োগ-পদায়নে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি গোপালগঞ্জ কিংবা বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রার্থীরা সুবিধা পেত বলেও অভিযোগ। এই এসআইদের মধ্যেও ৪৯ জন গোপালগঞ্জের ছিলেন বলে খবর এসেছে।
তবে এখন অভিযোগ উঠেছে, যোগ্যতা থাকলেও এই এলাকায় বাড়ি হওয়ার কারণেও কারও কারও চাকরি গেছে।
৪০তম ব্যাচের এই এসআইদের গত মাসেই প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর তা আর হয়নি।
বিএনপির দাবি কী ছিল
বিএনপি গত ১৭ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে প্রশিক্ষণে থাকা ৮০৩ জন এসআই এবং ৬৭ জন এএসপির নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছিল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সেদিন বলেছিলেন, “আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে, পুলিশ প্রশাসনে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বিদায় নেওয়ার পূর্বে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে মোট ৮০৩ জনকে নিয়োগ প্রদান করে। এর মধ্যে ২০০ জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং ৪০৩ জনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকারীদের হত্যাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য।”
এএসপি পদের ৬৭ জনও ছাত্রলীগের ‘ক্যাডার’ ছিল দাবি বলে দাবি করেন তিনি। সালাহউদ্দিন সব এসআই ও এএসপিদের নিয়োগ বাতিল করার দাবি জানান।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু দেখে দেখে বাতিল?
বিএনপি দাবি তোলার পর এসআইদের অব্যাহতি দেওয়া শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ অভিযোগ তোলে, সংখ্যালঘুদের ঢালাওভাবে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম দফায় ২৫২ জনকে বাদ দেওয়ার পরপরই সোশাল মিডিয়ায় খবর আসে, তাদের মধ্যে ৯১ জন হিন্দু। এছাড়া রয়েছেন দুজন বৌদ্ধ এবং একজন খ্রিস্টান।
এক সঙ্গে এতজন হিন্দুর বাদ পড়াটা ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “বিষয়টি দুঃখজনক এবং একইসঙ্গে প্রশ্নবোধক। স্বাভাবিকভাবে হয়ত ২/৪ জন অব্যাহতি পেতে পারে, একসঙ্গে এতজনকে অব্যাহতি স্বাভাবিক হয় কীভাবে?
“এই ঘটনা একটি খারাপ সঙ্কেত। ভবিষ্যতে এটি খারাপ কিছু বয়ে আনতে পারে। কারও বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ থাকে, তাহলে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে তদন্ত করা উচিৎ। এভাবে ঢালাও শাস্তি গ্রহণযোগ্য নয়।”