বাংলাদেশ সীমান্তে বেতার তরঙ্গে উর্দুতে ফিসফাস; সতর্ক দিল্লি

হ্যাম রেডিও।
হ্যাম রেডিও।

ভারতের পশ্চিম রণাঙ্গণে উত্তাপ; পূর্বে এখন শান্ত হলেও স্বস্তি নেই। তারমধ্যেই পূর্ব সীমান্তে বেতার তরঙ্গে উর্দুতে ফিসফিসানি সতর্ক করে তুলেছে নয়া দিল্লিকে।

কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা বুধবার এই খবর দিয়ে বলেছে, বেতার তরঙ্গে ওই আলাপ বাংলাদেশের মধ্য থেকেই হচ্ছিল, যা পশ্চিমবঙ্গের সৌখিন রেডিও (হ্যাম রেডিও) পরিচালকরা ধরে ফেলেন।

বিষয়টি বাংলাদেশের হ্যাম রেডিও ব্যবহারকারীদেরও জানানো হয়। এই কথোপকথন বাংলাদেশের ভেতর থেকে হওয়ার বিষয়টি তারাও নিশ্চিত হন বলে আনন্দবাজার জানিয়েছে।

খবরটি পেয়ে নয়া দিল্লি তদন্ত শুরু করেছে। তবে এনিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে ঢাকা-দিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কে চলছে টানাপড়েন। আট মাস পর দুই সরকার প্রধানের বৈঠকেও তা স্বাভাবিক হয়নি।

এদিকে দিল্লি যত দূরে সরতে থাকে, ইসলামাবাদ তত বেশি ঢাকার কাছে আসতে থাকে। অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক যতটা গাঢ় হয়েছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। দেড় যুগ পর দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকও সম্প্রতি হয়ে গেল।

ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক চির বৈরিতার। এর মধ্যে মঙ্গলবার কাশ্মিরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা, সীমান্তে শুরু হয়েছে রণ প্রস্তুতি।

এই যখন পশ্চিম সীমান্তের অবস্থা, তার একদিন বাদে বুধবার আনন্দবাজার জানাল, কিছু দিন আগেই পূর্ব সীমান্তে হ্যাম রেডিওর তরঙ্গে ধরা পড়া রহস্যজনক কণ্ঠ, সাংকেতিক বার্তালাপ এবং উর্দু আলাপচারিতা।

হ্যাম রেডিও বা অ্যামেচার রেডিও বা শৌখিন বেতার যোগাযোগ হলো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রামের নির্ধারিত কিছু অংশ ব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে তথ্য আদান-প্রদান করা। যারা এই রেডিও ব্যবহার করে তাদের বলা হয় ‘হ্যাম’।

গোপনে ভারতের হ্যাম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যস্তরে বসে ওই কথাবার্তা চালানো হচ্ছিল বলে পশ্চিমবঙ্গের হ্যামদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছে আনন্দবাজার।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রহস্যজনক’ বার্তার আদানপ্রদান গত জানুয়ারিতে প্রথম টের পান হ্যাম রেডিও চালক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস।

তিনি বলেন, “আমি রাতে রেডিও বন্ধ রাখি না। আওয়াজটা কমিয়ে রাখি। এক দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে শুনলাম, রেডিও থেকে কথোপকথনের আওয়াজ আসছে।

“ভেবেছিলাম, কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করছেন। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ বাড়িয়ে উত্তর দিই- কিউআরজ়েড, কিউআরজ়েড। যার অর্থ, কে বলছেন? এটি হ্যাম যোগাযোগের ভাষা। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি।”

অম্বরীশের বক্তব্য, তখনকার মতো কথা থেমে গেলেও কিছুক্ষণ পরে আবার শুরু হয়। তিনি আবার নিজের ‘কল সাইন’ দেন। এবারও তার সাড়া দেখে কথা বন্ধ হয়ে যায়।

অম্বরীশ বিশ্বাস তখন ঘটনাটি ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের অন্য সদস্যদেরও জানান। তাদের কেউ কেউ রাতে রেডিও ‘অন’ রেখে একই ধরনের বাক্যালাপ শোনেন। এরপর হ্যাম রেডিওর পরিচালকরা ওই কথোপকথনের উৎসস্থল খুঁজতে গিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে দেখেন, কলকাতা বা তার উপকণ্ঠে বসে বনগাঁ বা বসিরহাট পর্যন্ত কথা বলার মতো শক্তিতে যখন রেডিওকে কাজ করানো হচ্ছে, তখন ওই কথোপকথন ধরা পড়ছে না। কিন্তু শক্তি বাড়িয়ে যোগাযোগের পরিধি সীমান্তের ওপার পর্যন্ত প্রসারিত করলে ওই কথোপকথন ধরা পড়ে যাচ্ছে।

তা থেকেই হ্যাম পরিচালকরা নিশ্চিত হন যে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসে কিছু লোক এই কথোপকথন চালাচ্ছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে খুলনা ও যশোর থেকে।

স্ক্যানার ব্যবহার করে অম্বরীশ আরও বের করেন, রহস্যজনক ওই কথোপকথধন যখন তারা শুনছেন না, তখনও চলছে। “ওই কথোপকথনের আওয়াজ পেয়ে যখনই আমরা সাড়া দিতাম, তখনই ওরা রেডিও সঙ্কেতের তরঙ্গ বদলে ফেলত। অন্য তরঙ্গে গিয়ে কথা বলত।”

আনন্দবাজার লিখেছে, পশ্চিমবঙ্গের হ্যামরা এরপর বাংলাদেশের হ্যাম রেডিও ক্লাবের মহাসচিব অনুপ ভৌমিকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।

পশ্চিমবঙ্গের ‘রিপিটার’ ব্যবস্থা ব্যবহার করে বাংলাদেশে বসে কারা কথোপকথন চালাচ্ছে, তা বাংলাদেশের হ্যামরা চিহ্নিতও করে ফেলেন বলে অম্বরীশদের দাবি। কিন্তু তারা ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবকে সে সব নাম জানাননি।

অম্বরীশ জানান, জানুয়ারির মাঝামাঝি ছিল গঙ্গাসাগর মেলা। প্রতি বছর গঙ্গাসাগরে হ্যাম রেডিও ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়। ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবে নথিভুক্ত হ্যামরাই সেখানে যান।

অম্বরীশ বলেন, “সাগর মেলায় খুব শক্তিশালী সিগন্যালিং ব্যবস্থা থাকার সুবাদে মেলার সময়ে আমরা বাংলাদেশ থেকে ভেসে আসা ওই কথোপকথন আরও স্পষ্ট শুনতে পাই। বাড়িতে বসে পুরো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু গঙ্গাসাগরে সিগন্যাল অনেক শক্তিশালী। আর লবণাক্ত জলের উপর দিয়ে রেডিও সঙ্কেত খুব ভালোভাবে যাতায়াত করে। তাই ওখানে বসে আমরা বাংলাদেশের ওই রহস্যজনক কথোপকথন স্পষ্ট শুনতে পাই।

“সাঙ্কেতিক ওই কথোপকথনে কাউকে কোথাও পাঠানো বা কোনো জিনিস কারও মাধ্যমে অন্য কোথাও পাঠানোর কথা বলা হচ্ছিল। কে, কবে, কোথা থেকে সেই জিনিস সংগ্রহ করবে, সেই নির্দেশও দেওয়া হচ্ছিল। আলু, পেঁয়াজ বা অন্য কোনো সব্জির নাম ব্যবহার করা হচ্ছিল নির্দিষ্ট সময় বোঝাতে।”

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের হ্যামরা পুরো ঘটনা ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়। গঙ্গাসাগরে বসে রেকর্ড করা কথোপকথনও দিল্লিতে পাঠানো হয়।

এরপরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত দল অম্বরীশের বাড়িতে যায় তথ্য সংগ্রহ করতে।

মন্ত্রণালয় তদন্ত চালালেও এখনও কিছু বলেনি। ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সদস্যরা আপাতত ‘রিপিটার’ বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিনিধিরা ঘুরে যাওয়ার পরে মার্চ মাসেও বাংলাদেশে বসে ভারতীয় ‘রিপিটার’ ব্যবহার করে রহস্যজনক বার্তার আদানপ্রদান চালানো হচ্ছিল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads