সর্বকালের ইতিহাসে সূর্যের সবচেয়ে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে নাসার একটি মহাকাশযান।
‘পার্কার সোলার প্রোব’ নামে মহাকাশযানটি ইতোমধ্যে নক্ষত্রপুঞ্জের বাইরের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে যেখানে তীব্র তাপ এবং প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয়তার মুখোমুখি হচ্ছে বলে জানিয়েছে নাসা।
তীব্র তাপের কারণে গত কয়েকদিন ধরে মহাকাশযানটির সঙ্গে নাসা যোগাযোগ করতে না পারলেও বিজ্ঞানীরা আশা করছেন তিন-চার দিনের মধ্যে মহাকাশ যানটি থেকে সংকেত পাওয়া যাবে।
ওই প্রতিকূলতার মধ্যে যদি যানটি টিকে যায় তাহলে সূর্য আসলে কীভাবে কাজ করে তা আরও সূক্ষ্মভাবে জানা যাবে।
নাসার প্রধান বিজ্ঞানী নিকোলা ফক্স এ বিষয়ে বলেন, “শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ সূর্যকে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আপনি কোনো স্থানের পরিবেশ অনুভব করতে পারবেন না যতক্ষণ না আপনি সেখানে যাচ্ছেন। একইভাবে আমরা আমাদের নক্ষত্রের পরিবেশও বুঝতে পারব না যতক্ষণ না আমরা তার মধ্যে প্রবেশ করছি।”
তিনি জানান, ইতোমধ্যে মহাকাশ যানটি সূর্যকে ২১ বার অতিক্রম করেছে এবং ক্রমাগত আরও কাছে চলে যাচ্ছে।
ক্রিসমাসের ঠিক আগে সূর্যের সবচেয়ে কাছে এটি অবস্থান করবে, যা নক্ষত্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩.৮ মিলিয়ন মাইল দূরে থাকবে।
মিলিয়ন মিলিয়ন মাইল দূরত্বকে কাছের মনে না হতে পারার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন নাসার এই বিজ্ঞানী।
নিকোলা ফক্স বলেন, “আমরা সূর্য থেকে ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে আছি। আর এই দূরত্বকে যদি আমি এক মিটার ধরি তাহলে পার্কার সোলার প্রোব সূর্য থেকে মাত্র ৪ সেন্টিমিটার দূরে আছে- এতোটাই কাছাকাছি।”
তিনি জানান, যানটিকে চৌদ্দশ’ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ এবং তেজস্ক্রিয়তা সহ্য করতে হবে যার ফলে ভেতরের যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
১১.৫ সেন্টিমিটার (৪.৫ ইঞ্চি) পুরু কার্বন-কম্পোজিট শিল্ড দ্বারা সুরক্ষিত প্রোবটির কৌশলই হচ্ছে দ্রুত গিয়ে দ্রুত বের হয়ে আসা।
পৃথিবীতে এ যাবত মানুষের তৈরি যেকোনো বস্তু থেকে যানটি দ্রুতগামী এবং এর গতি ঘণ্টায় চার লাখ ত্রিশ হাজার মাইল; যার মানে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছতে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের কম সময় লাগবে বলেও এই বিজ্ঞানী জানান।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সূর্যকে ‘স্পর্শ’ করার জন্য এত এত পরিশ্রম কেন করা হচ্ছে? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন মহাকাশযানটি যখন সূর্যের বাইরের আবহে এবং তার জ্যোতির্মণ্ডলে প্রবেশ করবে তখন এর মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে চলা একটা রহস্যেরও সমাধান হবে।
ফিফথ স্টার ল্যাবের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেনিফার মিলার্ড বলেন, জ্যোতির্মণ্ডলের অভ্যন্তরে এই তীব্র তাপের কারণ আমাদের এখনও অজানা।
“সূর্যের পৃষ্ঠের তাপ প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তার জ্যোতির্বলয় বা জ্যোতির্মণ্ডল এবং বাইরের বায়ুমণ্ডল অতিসূক্ষ্ম যা আমরা সূর্যগ্রহণের সময় দেখতে পাই। যার তাপ কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছায়।
“আর এটি সূর্য থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। তাহলে এই বায়ুমণ্ডল কীভাবে এত গরম হচ্ছে?”
নাসার এই অভিযান বিজ্ঞানীদের সৌর বায়ু ও জ্যোতির্মণ্ডল থেকে নিরন্তর নির্গত অভিযোজিত কণা সম্পর্কে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝতে সহায়ক হবে। যেমন জ্যোতির্মণ্ডল থেকে নির্গত অভিযোজিত কণাগুলো কখন পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় অরোরা সৃষ্টি করে!
ড. মিলার্ড বলেন, “পৃথিবীতে প্রতিদিনের জীবনযাপনের জন্য সূর্য এবং তার কার্যবিধি, মহাকাশীয় আবহাওয়া ও সূর্যকণা সম্পর্কে বোঝা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
পৃথিবীর সঙ্গে মহাকাশ যানটির যোগোযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তারা একটি উদ্বেগজনক অপেক্ষার মধ্যে রয়েছেন বলে নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
নিকোলা ফক্স জানান, মহাকাশ যান থেকে আবার পৃথিবীতে সংকেত এলেই তার টিম তাকে একটি সবুজ হৃদয় ইমোজি পাঠিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক থাকার বার্তা দিবে।
এই সাহসী প্রচেষ্টা নিয়ে উদ্বেগে থাকলেও পার্কার সোলার প্রোবের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।
নাসার এই বিজ্ঞানী বলেন, “মহাকাশযানটি নিয়ে আমি চিন্তিত থাকলেও যানটি কঠিন থেকে কঠিনতর প্রতিকূল পরিস্থিতি সহ্য করার সক্ষমতা দিয়েই নকশা করা হয়েছে। এটা কঠিন ছোট একটা মহাকাশযান।”
বিবিসি অবলম্বনে মাহবুবা ডিনা