জানা-অজানা গল্প: কালের সাক্ষী ‘হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির’

হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির।
হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির।

বাংলার প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনগুলো শুধু যে ইতিহাসের ধারাপাত তা কিন্তু নয়, সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার এক জীবন্ত সাক্ষ্য। হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়া এই নিদর্শনগুলো যেন একেকটি যেন কালের কণ্ঠস্বর, যা কথা বলে গৌরবময় অতীতের।

মন্দির, মসজিদ, রাজপ্রাসাদ কিংবা দুর্গ- প্রতিটিই বহন করে ভিন্ন ভিন্ন যুগের শাসনব্যবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিল্পধারার ছাপ। পোড়ামাটির অলঙ্করণ, নকশাদার খিলান, গম্বুজ ও মিনার আমাদের স্থাপত্যরুচির সূক্ষ্মতা ও শৈল্পিক উৎকর্ষের পরিচায়ক। এসব স্থাপত্য হতে পারে আজকের প্রজন্মের কাছে একটি জীবন্ত পাঠশালা- যেখান থেকে জানা যেতে পারে আমাদের ঐতিহ্য, ইতিহাসের নানা বাঁক কিংবা ‘সময়ের মানচিত্র’।

নবরত্ন মন্দির তেমনই এক অনন্য নিদর্শন। দুইপাশের ধান ক্ষেতের বুক চিড়ে সেখান থেকে ছোট্ট একটি আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। এই পথের ধারেই পোড়ামাটির কাব্যে গাঁথা অনন্য এই নিদর্শন। বাংলাদেশে প্রাচীন যেসব হিন্দু মন্দির দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোর অন্যতম একটি এই হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির।

এই মন্দিরের কারণে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল গ্রামের নাম শুনেনি এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা।

কথিত আছে মন্দিরটি ১৬৬৪ সালের দিকে রামনাথ ভাদুরী নামে স্থানীয় এক জমিদার নির্মাণ করেছিলেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন আরও পরে মন্দিরটি বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময়কাল ১৭০৪ থেকে ১৭২৮ সালের মধ্যে কোন এক সময় নির্মাণ করা হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, রামনাথ ভাদুরী ছিলেন দিনাজপুরের তৎকালীন রাজা প্রাণনাথের বন্ধু। ভাদুরী তার বন্ধুকে তার রাজ্যের রাজস্ব পরিশোধে একবার সাহায্য করেছিলেন। তারই ফলস্বরূপ প্রাণনাথ দিনাজপুরের কান্তনগর মন্দিরের অদলে সিরাজগঞ্জে এই মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন।

আবার কেউ কেউ মনে করেন ভাদুরী তার নিজস্ব অর্থ ব্যয় করেই এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দিরের আশপাশে আরও তিনটি ছোট মন্দির রয়েছে। নবরত্ন মন্দিরের উত্তর পাশে আছে শিব-পার্বতী মন্দির। পাশে দোচালা আকৃতির চন্ডি মন্দির এবং দক্ষিণ পাশের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে আছে শিব মন্দির।

স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ একে ভাদুরী জমিদারের বাড়ি আর সেই জমিদারীর মন্দির নামেই চেনেন। অনেকে মনে করেন এই মন্দির খাজনা আদায়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। নবরত্ন মন্দিরের বাইরে পূজার আয়োজন হলেও ভেতরে পূজা হতে দেখেনি কেউ। এমনিভাবেই নবরত্ন মন্দিরকে দেখে এসেছে এলাকার মানুষজন। প্রথমদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নবরত্ন মন্দিরে পূজার জন্য আয়োজনের কথা বলা হলেও স্থানীয় হিন্দু পরিবারগুলো রাজি হয়নি।

এই এলাকায় এখনো দুই তিন মাইল জুড়ে ২০/২৫ ফুট মাটি খুঁড়লে পুরনো লম্বা প্রাচীর এবং সারি সারি ইটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, জমিদারী আমলের এই জমিদার বাড়ি মাটির নীচে হারিয়ে গেছে। স্থানীয় লোকজনও এটা বিশ্বাস করে। তাদের ধারণা মন্দিরগুলো জমিদার বাড়ির চেয়ে উঁচুতে ছিল, কোনো দৈববলে মন্দিরগুলো মাটির নীচে হারিয়ে যায়নি।

মন্দিরটি ১৫.৪ মিটার দীর্ঘ এবং ১৩.২৫ মিটার উঁচু। একটি শক্ত মঞ্চের উপর নির্মিত মন্দিরটির আয়তন প্রায় ১৫ বর্গমিটার। এটি তিনতলা বিশিষ্ট এবং উপরের অংশে মোট ৯টি চূড়া বা ‘রত্ন’ থাকায় একে ‘নবরত্ন’ মন্দির বলা হয়। যদিও এখন বেশিরভাগ চূড়া ভেঙে গেছে। মন্দিরের প্রথম তলায় রয়েছে বারান্দাবেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ, যার বাইরের দিকে ৭টি এবং ভেতরের দিকে ৫টি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে। গর্ভগৃহের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে দুটি আলাদা প্রবেশপথ রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় বারান্দা না থাকলেও স্থাপত্যশৈলীতে রয়েছে শৈল্পিক পরিপূর্ণতা।

ইট, চুন এবং সুরকি দিয়ে নির্মিত মন্দিরটির মূল সৌন্দর্য ছিল এর পোড়ামাটির চিত্রফলকে। সময়ের আবর্তে সেসব অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও, এখনও মন্দিরের গায়ে কিছু অলঙ্করণ টিকে আছে, যা ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে চোখে পড়ে। মন্দির চত্বরে প্রায় ২ একর জায়গা জুড়ে আরও দুটি স্থাপনা রয়েছে—একটি ছোট শিবমন্দির এবং একটি দোচালা মন্দির। ছোট শিবমন্দিরটি ‘মুড়া’ নামে পরিচিত, যেখানে একটি শিবমূর্তি পূজিত হয়। অবশ্য নবরত্ন ও দোচালা মন্দিরে বর্তমানে কোনো দেব-দেবীর মূর্তি নেই।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ইতিপূর্বে মন্দিরটির আংশিক সংস্কার করেছে এবং এর চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে। বগুড়া আঞ্চলিক অফিস থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন কর্মীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, মন্দিরটি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু দর্শনার্থী আসেন। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য প্রায় সাত বছর আগে মন্দির পর্যন্ত ২ কিলোমিটার দীর্ঘ পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়।

নবরত্ন মন্দির দর্শনে শুধু দেশীয় নয়, বিদেশি পর্যটকরাও আসেন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির ২৮ সদস্যের একটি পর্যটক দল মন্দিরটি পরিদর্শন করেন। দর্শনার্থীদের সব ধরনের সহযোগিতা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন