আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি সত্ত্বেও দেশব্যাপী কোনো সাঁড়াশি অভিযানে যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গেল বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মাঠে নামার কথা থাকলেও শেষমেশ সেটিও আর বাস্তবের রূপ পায়নি। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় জেল ভেঙে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি ও গুরুতর অপরাধীরা যেমন রয়ে গেছেন নাগালের বাইরে, তেমনি উদ্ধার হয়নি খোয়া যাওয়া সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ।
গেল ছয় মাসে বিভিন্নস্থানে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় বিচারিক ক্ষমতা পাওয়া যৌথবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন দৃশ্যত নিস্পৃহ ভূমিকায়।
সর্বশেষ বুধ ও বৃহস্পতিবার সারাদেশে চালানো বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনায়ও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন।
সেই নিরবতা ভাঙলো শুক্রবার রাতে গাজীপুরের একটি ঘটনার পর, যেখানে এক সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে ভাঙচুর করতে গিয়ে এলাকাবাসীর রোশে পড়ে আহত হন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ১৪ নেতাকর্মী।
এরপর সংগঠনটির আল্টিমেটামের মুখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেয় বিজ্ঞপ্তি, জানায় রাত থেকেই শুরু হবে সাঁড়াশি অভিযান গাজীপুরসহ সারাদেশে।
শুধু তাই নয়, হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সদর থানার ওসিকে প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেয় গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক ফয়সল হাসানের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে এই অভিযান পরিচালনার কথা জানানো হয়।
তবে কেন ও কী কারণে অভিযানের নাম ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
যৌথ এই অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, কোস্টগার্ড এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা অংশ নিয়ে থাকেন।
অভিযানে স্থগিত করা লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা না দিয়ে থাকলে সেগুলো জব্দ করা হবে। একই সঙ্গে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেহাত হওয়া ও খোয়া যাওয়া অস্ত্রসহ যেকোনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
বিচারিক ক্ষমতার আওতা
বিচারিক ক্ষমতা থাকায় সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তারা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে বা গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারবেন।
সাধারণত দেশে জরুরি অবস্থার পরিস্থিতি ছাড়া সেনাবাহিনীর হাতে এই ক্ষমতা সাধারণত দেওয়া হয় না।

বাংলাদেশের সব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি’ পাওয়ার দেওয়ার দাবি ওঠে। তবে, নির্বাচনের মাঠে কখনোই সেনাবাহিনীকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে।
মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেনাবাহিনীকে এই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পরও এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা আলোচনা উঠেছিল।
সেসময় সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এমদাদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, এই বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার পর ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে অন্যের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল তাতে বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭টি ধারায় সেনা কর্মকর্তারা তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ এবং ১৪২ ধারা অনুযায়ী সেনাবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির এসব ধারা অনুযায়ী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়ায় এখন থেকে সেনা কর্মকর্তাদের সামনে কোনো অপরাধ হলে অপরাধীদের সরাসরি গ্রেপ্তার করতে পারবেন, দিতে পারবেন জামিনও।
বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পারবেন সেনা কর্মকর্তারা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পুলিশকে নির্দেশও দিতে পারবে তারা। এছাড়া বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি করতে পারবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশ জুড়ে বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খলা, বিভিন্ন দাবিতে রাস্তা আটকে মিছিল সমাবেশ করা নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাাঁড়িয়েছে।
বিচারিক ক্ষমতা থাকায় সেনা কর্মকর্তাদের বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে পারার ক্ষমতাও রয়েছে।
এছাড়াও স্থানীয় উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আদেশ জারি করতে পারবে, আটক করতে পারবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত ১৯ জুলাই রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
সর্বশেষ ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় সেনা সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে বিশেষ অভিযান চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে। বিভিন্ন কাজে মাঠ প্রশাসনকে সহায়তাও করেছে সেনাবাহিনী।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় দায়িত্ব পালন করেছিল ফখরুদ্দিন আহমেদের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
সেসময় দেশে জরুরি অবস্থা জারি ছিল, ফলে আলাদা ঘোষণা দিয়ে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হয়নি।
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
সারাদেশে শুরু যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’