বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে থাইরয়েডজনিত রোগীর সংখ্যা। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ এই হরমোনজনিত রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ ধরা পড়ছে বা চিকিৎসকের শরণাপণ্ন হচ্ছেন। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অনেকেই এই রোগটি সম্পর্কে সেভাবে খোঁজ রাখেন না বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ইতস্তত বোধ করেন।
এ বিষয়ে কথা বলার আগে আসুন থাইরয়েড রোগ (Thyroid Disease) সম্পর্কে জেনে নিই। এককথায় বললে এটি এক ধরনের হরমোনজনিত সমস্যা যা থাইরয়েড গ্রন্থির (thyroid gland) অস্বাভাবিক কার্যকলাপের কারণে হয়। গলার সামনের দিকে অবস্থিত প্রজাপতি-আকৃতির এই গ্রন্থি শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এটা অনুমেয় থাইরয়েড শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
থাইরয়েড রোগের লক্ষণ কী কী?
থাইরয়েড রোগ থাকলে আপনার বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য রোগের সঙ্গে থাইরয়েডজনিত রোগের লক্ষণের বেশ মিল দেখা যায়। এ কারণে থাইরয়েডে আক্রান্ত যেকেউ শুরুতেই ধরতে পারেন না তিনি থাইরয়েডজনিত রোগে ভুগছেন কিনা।
লন্ডনভিত্তিক ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড রোগের লক্ষণ দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে – অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন (হাইপারথাইরয়েডিজম) এবং খুব কম থাইরয়েড হরমোন (হাইপোথাইরয়েডিজম) থাকার সাথে সম্পর্কিত।
আর এই লক্ষণগুলো প্রায়ই দুটি অবস্থার মধ্যে “বিপরীত” হয়। এর কারণ হল হাইপারথাইরয়েডিজম বিপাককে ত্বরান্বিত করে এবং হাইপোথাইরয়েডিজম বিপাককে ধীর করে দেয়।
হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণ:
স্বাভাবিকের চেয়ে ধীর হৃদস্পন্দন
ক্লান্ত বোধ (ক্লান্তি)
ওজন বৃদ্ধি
ঠাণ্ডার প্রতি সংবেদনশীল বোধ
শুষ্ক ত্বক এবং শুষ্ক এবং রুক্ষ চুল
বিষণ্ণ বোধ, মেজাজ হারানো
অতিরিক্ত মাসিক (মেনোরেজিয়া)
হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষণ:
স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হৃদস্পন্দন
ঘুমে ব্যাঘাত
ওজন হ্রাস
তাপের প্রতি সংবেদনশীল বোধ
ত্বকে আর্দ্রতা বা ঘাম
উদ্বিগ্ন, খিটখিটে বা নার্ভাস বোধ
অনিয়মিত মাসিক চক্র বা মাসিকের অভাব (অ্যামেনোরিয়া)
থাইরয়েডে আক্রান্তের ঝুঁকিতে যারা
পুরুষ ও নারী যেকেউ যেকোনো বয়সে থাইরয়েডজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। নারীদের থাইরয়েড রোগ হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষের চেয়ে পাঁচ থেকে আট গুণ বেশি।
যেসব পরিবারে থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত রোগী রয়েছে সেসব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
টার্নার সিনড্রোমও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। টার্নার সিনড্রোম তখনই ঘটে যখন আপনার কন্যা শিশুটি অনুপস্থিত বা আংশিক এক্স ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
এছাড়া যারা অন্য রোগের জন্য আয়োডিন সমৃদ্ধ ওষুধ খান তাদেরও এই রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
এর বাইরে যেসব অঞ্চলের মানুষ আয়োডিনযুক্ত লবণ খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করেন না, বা আয়োডিনযুক্ত লবণ নেই, সেসব অঞ্চলের মানুষের থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগ দেখা দিতে পারে।
নারীদের ক্ষেত্রে যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি তাদের থাইরয়েডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। রেডিয়েমন থেরাপিও হরমোনজনিত ভারসাম্যে সমস্যা তৈরি করতে পারে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়ে থাকেন।
এসব বিষয়াদির পাশাপাশি কারো যদি রক্ত স্বল্পতা থাকে, ডায়েবেটিসের টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত ব্যক্তি, সিলিয়াক রোগ, সিলিয়াক রোগ, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা রিউমেটিক ফিবার, সজোগ্রেন সিনড্রোমে আক্রান্তদের মধ্যে থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ২০২৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে আক্রান্তদের মধ্যে হাইপোথাইরয়েডিজমের রোগী বেশি। এবং যে হারে এই রোগের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তা বিশ্ব পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: