মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল কাণ্ডারি, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী আজ। ভাওয়ালের (বর্তমানের গাজীপুর) কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মা মেহেরুন্নেসা খানম ও বাবা মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াসিন খানের সন্তান তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল তখনকার বেশির ভাগ বাঙালি মুসলমানের মতোই মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারার সঙ্গেই তিনি কমবেশি পরিচিত হন বাল্যকালেই। ফলে উদারতাবাদী, ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত ধ্যানধারণারও বিকাশ ঘটে তাঁর মধ্যে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৪৩ সালে স্কুলে পড়ার সময় মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য হন তিনি, যুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। পরের বছর ১৯৪৪ সালে তিনি একদিকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন, অন্যদিকে মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি পরিচিত হন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তবে পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার আগেই মুসলিম লীগের প্রতি তার মোহভঙ্গ ঘটে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ বছরেই তিনি আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) উত্তীর্ণ হন তিনি। এর এক দশক পর তিনি ১৯৬৪ সালে কারাবন্দি অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্র হওয়ার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত না থাকলেও তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ১৯৪৯ সালে গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা। এ সময় থেকেই বিস্তৃত হতে থাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন— যার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি, ছিলেন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যও।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কমিটির সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটলে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত হন। এর পর ১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর থেকেই মূলত আওয়ামী লীগ গণমানুষের সংগঠনের রূপান্তরিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদও হয়ে ওঠেন সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মুজিব – তাজউদ্দীন জুটির নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তিকামী সংগঠন। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের পর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল জয়লাভ করে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আন্দোলন, নির্বাচন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দানে তাজউদ্দীন পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। যার সফল পরিণতি মহান মুক্তিযুদ্ধ।
দীর্ঘ সংগ্রাম ও ধারাবাহিক আন্দোলনের পরিক্রমায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার ( মুজিবনগর সরকার) গঠনে তিনি পালন করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত বিপ্লবী সরকারে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তিনিই সেদিন বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর হিসেবে নামকরণ করেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মূলত তাঁর নেতৃত্বেই দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের। কারামুক্তির পর স্বাধীন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাজউদ্দীন আহমদের উপর অর্পিত হয় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। দেশের প্রথম বাজেট ঘোষণার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারীও ছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। দেশের অর্থনৈতিক অভিযাত্রাও তাঁর হাত ধরেই। দুর্ভাগ্য ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর তাজউদ্দীন আহমদকে।
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের উন্মেষ ও পুনর্গঠনের অন্যতম নায়ক। রাজনীতিতে ত্যাগ, তিতিক্ষা,মেধা, দক্ষতা, সততা ও আদর্শের এক অনন্য প্রতীক তিনি। বিচক্ষণতা, দায়িত্ববোধ,কর্তব্যবোধ ও নেতৃত্বের প্রতি অনুগত একজন দৃঢ়চেতা পরিশীলিত রাজনীতিবিদ ছিলেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে তাঁর স্বাধীনতার ডাকের ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনা এই তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বেই। ঘাতকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অপর জাতীয় তিন নেতার সঙ্গে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকেও হত্যা করে।
জাতির সংকটময় ও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে নেতৃত্বের হাল ধরতে যিনি এগিয়ে আসেন তিনি শুধু নেতা নন ত্রাতাও। অনৈক্য ও বিভেদের ফাঁদ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যিনি কঠিন ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে কার্পণ্য করেননি তিনিই তো নায়ক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হন তবে তাজউদ্দীন আহমদ অবশ্যই অন্যতম নায়ক। বঙ্গবন্ধুর সৌভাগ্য তিনি তাজউদ্দীন আহমদের মতো একজন যোগ্য সহকর্মী পেয়েছিলেন। যিনি বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা কে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর নির্দেশিত পথেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুক্তির সংগ্রামে রূপান্তরিত করেছেন। সফল করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধ।
যার রাজনৈতিক জীবন গণমুক্তির স্বপ্নতাড়িত। যিনি একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। যিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ও স্বনির্ভর একটি রাষ্ট্র নির্মাণের সংগ্রামে আপসহীন— তিনিই তো তাজউদ্দীন। জন্মশতবার্ষিকীতে অর্ঘ্য তাঁর প্রতি।
নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন প্রিয় মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার বন্ধন। অবহেলা,বঞ্চনা আর অভিমানে আদর্শিক এ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এ সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু। ধীমান ও সাহসী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের এক অনিবার্য সংশপ্তক। মহান এই দেশপ্রেমিকের ১০০ তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সাংবাদিক ও সমাজকর্মী