এই জুলাইয়ে স্লোগানের তীর ঘুরে গেল তারেক রহমানের দিকে

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এক বছর আগের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ছিল মিছিলে-স্লোগানে উত্তাল; সেই স্লোগানের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে লক্ষ্য করে দেওয়া স্লোগান অনেকের চোখেই তখন শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

সেই জুলাইয়ে চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে পরিণত হয়েছিল অভ্যুত্থানে। তাতে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে গিয়ে ‍ওঠেন শেখ হাসিনা। দেড় দশক ধরে চাপে থাকা বিএনপি হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পায়।

কিন্তু বছর ঘুরে সেই সেই জুলাইয়ে আবার স্লোগান উঠেছে বিএনপি ক্যাম্পাসে। এবারও শালীনতার মাত্রা ছাড়ানো স্লোগান; তবে লক্ষ্য বদলে এখন বিএনপি এবং দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকে।

শুধু তাই নয়, এতদিন আভাসে-ইঙ্গিতে বিএনপির বিরুদ্ধে বললেও এখন খোলাখুলিভাবে বিএনপি ও তারেক রহমানের নাম নিয়ে হুমকি দিচ্ছেন অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ তুর্কিরা।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে হত্যার পর তার লাশের ওপর পাথর মারা, ওপরে দাঁড়িয়ে উল্লাসের ভিডিও প্রকাশের পর ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে সবার মনে। হামলাকারীদের বিএনপির সহযোগী সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও গা বাঁচাতে পারছে না খালেদা জিয়ার দল।

এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির মধ্যে আবার ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র আশঙ্কা জেগে উঠেছে; যে শঙ্কার কথা গত বছর অভ্যুত্থানের পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই তুলেছিলেন।

২০০৭ সালে রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারির পর দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতির বাইরে ছুড়ে ফেলার একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, যা ‘মাইনাস টু’ নামেই পরিচিতি পায়। দেশ-বিদেশের সেই ষড়যন্ত্র শেষতক সফল হয়নি।

এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে টানা দেড় দশক শাসন ক্ষমতা ধরে রাখে, তাতে বিএনপি ছিল ব্যাপক চাপে। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে যেতে হয় কারাগারে, দণ্ডিত হওয়ার পর আর দেশে ফেরার ঝুঁকি নেননি তার ছেলে তারেক রহমানও। গত বছর অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর খালেদা জিয়া ‍মুক্তি পেলেও তারেক এখন লন্ডনেই থেকেই দল চালাচ্ছেন।

অভ্যুত্থানকারী তরুণদের সঙ্গে শুরুতে বিএনপির নিবিড় সম্পর্ক দেখা গেলেও নানা প্রশ্নে তাদের মতভেদ ধীরে ধীরে বিরোধে গড়ায়। বিশেষ করে তারা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন দল গড়ার পর থেকে এই ‘কিংস পার্টি’ নিয়ে বিএনপির সন্দেহ বাড়ছে।

রাষ্ট্রপতি অপসারণ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, জুলাই সনদ প্রণয়ন, নির্বাচনের সময় ইত্যাদি নানা বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে এনসিপির মতভেদ চলছিল। তানিয়ে এনসিপি নেতারা নাম উল্লেখ না করে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে কথা বলছিলেন।

মাস খানেক আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির ইশরাক হোসেনকে শপথ না করানো নিয়ে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের দুই তরুণ উপদেষ্টাকে আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়, তাদের পদত্যাগ দাবি করে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দেওয়ার হুমকিও দেন বিএনপির কোনো কোনো নেতা।

এক মাস আগে লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর দলীয় নেতাদের সংযত হওয়ার বার্তা দেন তারেক, তারপর বিএনপি নেতারাও চুপ করে যান।

কিন্তু গত বুধবার মিটফোর্ডে প্রকাশ্যে খুনে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের জড়িত থাকার খবর প্রকাশের পর শুক্রবার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। এই মিছিলের পেছনে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করছেন বিএনপির নেতারা।

এনসিপি নেতা সারজিস আলম ফেইসবুকে লিখেছেন- “আপনার দলের নেতাকর্মী নামক কতিপয় নরপিশাচকে সামলান, জনাব তারেক রহমান। যে নিয়মে আওয়ামী লীগের করা হত্যার দায় খুনী হাসিনার উপর বর্তায়, সেই একই নিয়মে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের করা খুনের দায় আপনার উপরেও বর্তায়।”

সাতক্ষীরায় এনসিপির সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন নাহিদ ইসলাম।

যার পদত্যাগের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলেছিল বিএনপি, সেই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া ফেইসবুকে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে ‘প্রস্তর যুগের’ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

এসবের প্রতিক্রিয়ায় তারেক নিজেই ফেইসবুকে লিখেছেন, “বিএনপি তো সরকার চালায় না। তাহলে সরকার কেন এদের (মিটফোর্ডের খুনিদের) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”

বিএনপি ও তারেক রহমানকে জড়িয়ে বা ইঙ্গিত করে সোশাল মিডিয়ায়ও নানা ধরনের লেখালেখি হচ্ছে। যা নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, দল থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও এ ধরনের প্রচার ‘পরিকল্পিত’ ও ‘নোংরা রাজনীতির চর্চা’।

কারা পরিকল্পিতভাবে, কী উদ্দেশ্যে এই প্রচার চালাচ্ছেন, সে বিষয়ে বিএনপি নেতারা মুখ খোলেননি। তবে তারেক রহমান শনিবার দলের এক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, “আমি আজ থেকে ৮-৯ মাস আগে বলেছিলাম, অদৃশ্য শত্রু আছে। সেই অদৃশ্য শত্রু ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে।”

এই সভায়ও অদৃশ্য সেই শত্রু কারা, তা স্পষ্ট করেননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে দলের মধ্যে অনেকে এর সঙ্গে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা মেলাতে চাইছেন।

এনসিপিকে আক্রমণ করে নানা বক্তব্যের পর সম্প্রতি বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, নির্বাচনী জোটের বিষয়ে তাদের দরজা এনসিপির জন্য খোলা।

কিন্তু বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে পদযাত্রায় থাকা এনসিপির নেতারা জনসভায় দিচ্ছেন ভিন্ন বার্তা। জুলাই অভ্যুত্থান স্মরণে তাদের সেই কর্মসূচি এখন বিএনপির চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে শোর তুলেছে।

এক সভায় এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, “ব্যবসায়ীরা আগে শেখ হাসিনার সিরিয়াল ধরত, এখন ধরে লন্ডনের সিরিয়াল। বিএনপি সেই ব্যবসায়ীদের থেতলে দিয়েছে। মানুষ আর এই ধোঁকাবাজি মানবে না।”

এনসিপির সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “আমরা জনগণের স্বাধীনতা চেয়েছি, কিন্তু একটি দল মনে করছে, তারা লুটপাট, দখলদারিত্ব আর চাঁদাবাজির স্বাধীনতা পেয়েছে। যারা হাসিনাকে তাড়িয়েছে, তারা চাঁদাবাজদের ভয় পায় না।”

যশোরে জনসভায় তিনি বিএনপিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, “কোটি-কোটি মানুষ, লক্ষ-লক্ষ্য মানুষ আমাদের দেখাবেন না। আমরা ফ্যাসিবাদের আমলে দেখেছি, কার কত মানুষ ছিল।”

এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ তো বিএনপিকে হুমকিই দিয়ে রেখেছেন- “ছাত্ররা ঘরে ফিরে যায়নি … জুলাই শেষ হয়নি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads