তারেক রহমানের ফেরা এখন ‘নিগূঢ় রহস্য’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যিনি লন্ডনে বসে পরিচালনা করছেন তার বাবার দল। ছবি: এএফপি
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যিনি লন্ডনে বসে পরিচালনা করছেন তার বাবার দল। ছবি: এএফপি

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা আবারও অনিশ্চিত। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ‘শিগগির দেশে ফিরছেন তারেক রহমান’- এমন শিরোনামে প্রায় প্রতিমাসেই খবর এসেছে কোনো কোনো সংবাদপত্রে। সর্বশেষ তিনি নিজ মুখেই বলেছিলেন ‘দ্রুতই হয়তো ফিরছি’।

দিন যত গড়াচ্ছে তারেক রহমানের ফেরার দিন-তারিখ ততই যেন ‘নিগূঢ় রহস্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর আগে বেশ কয়েকবার বিএনপির কর্মীরা আশা করলেও তাদের মনের আশা পূরণ হয়নি; লন্ডন থেকে মায়ের সঙ্গে ফিরতে পারেন এমনটি শোনা গেলেও শেষমেশ সে পথেও হাঁটেননি দলের ভবিষ্যতের কর্ণধার।

তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমান দেশে ফেরার পর তার জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে চিঠি দিয়েছিল বিএনপি, যাতে উল্লেখ করা হয়েছিল জোবাইদা রাজনীতিতে জড়িত না হলেও তারেকের স্ত্রী হিসেবে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে

তারেক রহমান কেন ফিরছেন না, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় ওই চিঠি থেকে। স্ত্রী জুবাইদার মতো তারও জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে- এমন ধারণাই দেওয়া হয় নানাভাবে।

তারেকের জন্য যদি তার স্ত্রীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তাহলে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করাই যায়। তাহলে প্রশ্ন উঠবে ঝুঁকিটি কোন দিক থেকে? বিএনপি অবশ্য কখনও এবিষয়টি খোলাসা করেনি। তাতে দলটির কর্মীদের মধ্যে রয়েছে হতাশা।

বৈরী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সরকারের পতন হলেও  দলটির নেতারা এক কথাই বলে আসছেন, ফেরার ‘পরিবেশ’ হলেই ফিরবেন তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তারেক রহমান। তার আগে মা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় প্রশাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হাওয়া ভবনে বসে তিনি সব কিছু চালাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

গ্রেপ্তার হওয়ার পরের বছর রাজনৈতিক সমঝোতায় মুক্তি পাওয়ার পর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তারেক লন্ডন চলে যান, তারপর আর ফেরেননি।

এর মধ্যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চারটি মামলায় তারেকের কারাদণ্ড হয়। তার মধ্যে একটি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলা। বৈরী অবস্থায় তারেক তার ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরও দেশে ফেরেননি। মা খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দণ্ড নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিলেও দেশে আসেননি তারেক।

গতবছর লন্ডনে পৌঁছালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে বাসায় ফেরেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মাঝে-মধ্যেই বলতেন, তারেক রহমানের সাহস থাকলে দেশে এসে তার বিরুদ্ধে মামলা মোকাবেলা করুক। তাকে ফেরত আনতে চেষ্টাও চালায় আওয়ামী লীগ সরকার, কিন্তু সফল হয়নি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রথমেই কারাগার থেকে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

এরপর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে আদালতও তাকে অব্যাহতি দেয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলাসহ অন্য মামলার দণ্ড থেকেও অব্যাহতি পান তারেক।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তারেকের পাসপোর্ট নবায়ন না হওয়ায় তিনি পাসপোর্টহীন ছিলেন বলে বিএনপি অভিযোগ করত প্রায় নিয়মিতই, যদিও বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের দেশে ফেরার জন্য পাসপোর্ট অপরিহার্য নয়।

আগস্টের পালাবদলের পর অবশ্য পাসপোর্ট সমস্যার সুরাহাও হয়েছে।

এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশ যাবেন, তখন তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। যদিও চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার একবছর কেটে গেছে।

সর্বশেষ ৬ অক্টোবর বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি কবে দেশে ফিরছেন। উত্তরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই ইনশাআল্লাহ।”

গেল মাসে দলের মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমদ এক সাক্ষাৎকারে আশ্বস্ত করেছিলেন নভেম্বরের শেষ নাগাদ তাদের নেতা দেশে ফিরবেন বলে তিনি আশা করছেন।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে। তাছাড়া তারেক রহমান এখনও ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হননি। সে ক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার পরপরই কি তাহলে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান? নেতাকর্মীরা এমনটি আশা করলেও এখনই বলা যাচ্ছে না প্রকৃত দিনক্ষণ।

এরই মধ্যে তারেক রহমান এসে কোথায় থাকবেন সেই জায়গাও ঠিকঠাক করা হয়েছে।

দলীয় কয়েকটি সূত্রের সঙ্গে কথা হয়েছে দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদকের। তাদের যে বক্তব্য তা থেকে এটি অনুমেয় যে, তারাও তাদের নেতার ফেরার দিনক্ষণের রহস্য ভেদ করতে পারছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন নেতা বলেছেন, “আপাতত দৃষ্টিতে তারেক রহমান আসছেন এমনটা মনে হলেও তিনি আসলে আসছেন না। আসলে আরও আগেই আসতেন।”

তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- কেন এই বিলম্ব? জবাবে তার কণ্ঠে শোনা গেল সেই পুরনো ‘জীবন ঝুঁকির’ কথা, যেমনটি আশঙ্কা করা হয়েছিল তারেক রহমানের স্ত্রীর ফেরার পর। তবে এবার খানিকটা পরিষ্কার হওয়া গেল ঝুঁকিটা কোথায়।

ওই নেতা বলেন, “আমি মনে করছি তার এই না আসার পেছনে কারণ জামায়াত!”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক নেতা দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকেই মূলত দেশে ফিরছেন না তারেক রহমান।

তাদের দাবি, দেশে এলে তারেক রহমানের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে জামায়াত।

বিএনপি নেতাদের ধারণা, শুধু তারেক রহমান নয়, দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত জামায়াত।

“জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে পরিকল্পিতভাবে পুলিশের অস্ত্র লুট করেছে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা। সেসব এখনও তাদের দখলেই আছে। বিভিন্ন এলাকায় তারা সংগঠিত হচ্ছে। আমরা শুনি তারা রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের সময় প্রশিক্ষণ নেয়,”দ্য সান টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির একজন নেতা।

তিনি জানান, দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে তারেক রহমানের বক্তব্য এবং দলীয় একাধিক শীর্ষ নেতারে সাথে কথাবার্তায় তিনি বুঝতে পেরেছেন সেনাবাহিনীর ওপর জামায়াতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এই মুহূর্তে। সেনাবাহিনী ও জামায়াত মিলেই হত্যা করতে পারে তারেক রহমানকে- এমন আশঙ্কা থেকেই দেশে আসছেন না তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads