এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর জন্মভিটায় একদিকে যেমন চলছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়, অন্যদিকে শোনা গেছে বাংলাদেশের স্থপতির সমাধি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি- দুইয়ে মিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক উত্তেজনা। যার রোশে ভাঙচুর হয়েছে সমাবেশস্থল, ইউএনও’র গাড়ি, আগুনে পুড়েছে পুলিশের টহল যান।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, এনসিপির নেতারা যে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন, পুলিশি পাহারায় কয়েক মিনিটের ‘ফটোসেশন’ ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তীব্র প্রতিরোধের মুখে তারা গোপালগঞ্জে আটকা পড়েন।
এনসিপি নেতা নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যখন রওনা দিয়েছি, তখন গ্রাম থেকে যত আওয়ামী লীগ-যুবলীগ, সারা বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন এসে আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা এখন একটি জায়গায় অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি শান্ত। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন, আর্মি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে।”
স্থানীয় সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, শহরের পৌর পার্ক ও লঞ্চ ঘাট এলাকা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
দুপুর আড়াইটার দিকে যখন এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর ওই এলাকা অতিক্রম করার চেষ্টা করে, সেই সময় তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়।
গুলি, রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের সাথে হামলাকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা চলছে। পুলিশের হামলায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, যাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
সমাবেশস্থলের মঞ্চের পাশাপাশি চেয়ারগুলো রাস্তায় এনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে এবং যানচলাচলও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলা প্রশাসক মো.কামরুজ্জামান গোপালগঞ্জ জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছেন বলে খবর দিয়েছে দৈনিক সমকাল।
এর আগে বুধবারের কর্মসূচি ঘিরে সকালে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনার পর গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি বহরে হামলার খবর পাওয়া গেছে। এর কিছুক্ষণ পর সমাবেশস্থলে ভাঙচুর চালায় উত্তেজিত জনতা।
সকালে সদর উপজেলার টেকেরহাট সড়কের কংশুর নামক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে দৈনিক সমকাল খবর দিয়েছে।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসানকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে, বেলা ১১টার দিকে ওই সড়কে স্থানীয়রা ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া খবর পেয়ে তিনি সেখানে গেলে গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে গাড়ি চালক আহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, “জাতীয় নাগরিক পার্টির জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে আজ গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে পদযাত্রা ও পথসভা করার কথা রয়েছে। তাদের কর্মসূচি বানচালের জন্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সমর্থকেরা প্রথমে পুলিশের গাড়িতে হামলা করে, পরে আমার গাড়ি বহরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।”
এর আগে সকালে সদর উপজেলায় পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের খবর এসেছে একই পত্রিকায়, যেখানে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।
অবশ্য দৈনিক প্রথম আলো একই ঘটনায় তিন জন পুলিশ সদস্যের আহতের খবর দিয়েছে।
বিবিসি বাংলার খবরে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগকে দায়ী করেন গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মো. সাজেদুর রহমান, যদিও ছাত্রলীগ এ ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসাবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে। পরে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

সংগঠনের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পাতায় এক পোস্টে অভিযোগ করা হয়, “ইউনূসের প্রেস সচিব ডাস্টবিন শফিক আর জঙ্গি নেতা মাহফুজের নির্দেশে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। এনসিপি নামক দলকে রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল দিতে গিয়ে গোপালগঞ্জের সাধারণ জনগণের উপর নির্বিচার অত্যাচার করে যাচ্ছে ইউনূসের পেটোয়া বাহিনী।”
গত ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্যান্য জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচি করলেও গোপালগঞ্জের কর্মসূচিকে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
এনসিপির কর্মসূচি ঘিরে সকাল থেকে দুই বিপরীত দৃশ্য দেখা গেছে সমাবেশ স্থলের আশেপাশের এলাকায়। থরে থরে সাজিয়ে রাখা ফাঁকা চেয়ার পাহারা দিচ্ছিলেন পুলিশ সদস্যরা, মঞ্চে নারী কণ্ঠের একজন দিচ্ছিলেন নানা ঘোষণা। তবে সেসময় নতুন এই দলটির কোনো অনুসারী বা কর্মীকে সেখানে দেখা যায়নি।

অন্যদিকে, বিভিন্ন সড়ক ছিল সমাবেশবিরোধী হাজার হাজার মানুষের মিছিলে উত্তাল। তাদের কারো কারো হাতে লাটিসোঁটার পাশাপাশি ধাতব বস্তু দেখা গেছে। কণ্ঠে ছিল- ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘গোপালগঞ্জের মাটি, শেখ হাসিনার ঘাঁটি’সহ নানা ধরনের স্লোগান।
চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে সরকারের সরবরাহ করা এক্সেভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি।
‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচি নাম দেওয়ায় তাই এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল- এনসিপির অনুসারীরা হয়তো এবার বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে হামলার চেষ্টা চালাবে।
“হাসনাত আব্দুল্লাহ” নামের একটি ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, “আগামীকাল গোপালগঞ্জে স্লোগান হবে ‘মুজিববাদ-মুর্দাবাদ’; ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’।”
ওই অ্যাকাউন্ট হাসনাত আব্দুল্লাহর ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট না হলেও পেজটির অনুসারীর সংখ্যা ১ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি।
যা নিয়ে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক লিখেছেন, “লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে এনসিপি সারাদেশে যে ক্যাম্পেইন করছে, সেটিকে জুলাই পদযাত্রা নাম দিয়েছে এবং বাকি সব জেলার বেলাতেই সার্জিস আলম সেগুলোকে পদযাত্রাই বলেছে। গোপালগঞ্জের বেলাতেই শুধু ‘মার্চ টু’ ঘোষনা দেয়া হয়েছে। পরিস্কারভাবেই এটি এনসিপির স্বাভাবিক দেশব্যাপী পদযাত্রার বাইরে একটি ভিন্ন মাত্রা এবং ইচ্ছাকৃত উস্কানি। এর আগের ‘মার্চ টু বত্রিশ নম্বর’ এর ফলাফল আমরা দেখেছি।”
তিনি আরও লিখেছেন, “মনে রাখতে হবে, দেশের যে অবস্থা, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বুলশিট ফেসবুক পোস্ট দিয়ে সেটিকে ধামাচাপা দেয়ার উপায় নেই। আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় দেশের এমন তেইশ মারছে যে একে একে বাংলাদেশীদের জন্য বিভিন্ন দেশের ভিসা পর্যন্ত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। নেপাল-ভুটানের মতো দেশে এখনও যে ভিসা ফ্রি যাওয়া যায়, সেটিই একটা বিষ্ময়। এই সময় ইলেকশন পিছিয়ে বাংলাদেশ নামের দুধেল গাইকে দোহানোর জন্য একটা বড় হাঙামা দরকার। গোপালগঞ্জ সেই হাঙামা তৈরির ফাঁদ কী না, সেটা গভীর ভাবে ভাবতে হবে।”

‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ’ নামের একটি ভেরিফায়েড পেজ থেকে এস্কেভেটরের ছবি জুড়ে দিয়ে লেখা হয়েছে, কালকের জুলাই পদযাত্রা নিয়ে এনসিপি গোপালগঞ্জ যাচ্ছে। তাদের গাড়ীবহর মানুষ যেমন চায়!
পাতাটিতে অনুসারীর সংখ্যা ৬ লাখ ৬৪ হাজার, এবং বিভিন্ন সময় উস্কানিমূলক পোস্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
এদিকে দুপুরে সমাবেশস্থলে বিক্ষুব্ধ জনতার ভাঙচুরের পর সেনাবাহিনী ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ধাওয়া দেয়। এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। হামলায় আহত একজন বিক্ষুব্ধ কর্মীকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখা গেছে সেনা সদস্যদের।
এনসিপি’র নেতা কর্মীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের লোকজন এনসিপি’র ওপর হামলা করলেও পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি।
পরে সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় গোপালগঞ্জে সমাবেশ শেষে ফিরে যাওয়ার সময়ও হামলার মুখে পড়ে এনসিপি নেতাদের বহনকারী গাড়িবহর। এসময় গাড়িবহরের ওপর ব্যাপক ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয় বলে জানা গেছে।
পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় এনসিপির নেতাদের শহর থেকে বাইরে বের করার চেষ্টা করা হলেও ব্যাপক হামলার মুখে তাদের আবার শহরে ফিরিয়ে আনা হয়।

শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে এই হামলার ঘটনা ঘটে।
এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি ছোঁড়া হয় বলে ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজন সাংবাদিক নিশ্চিত করেছেন। এককপর্যায়ে এনসিপি নেতাদের গাড়ি বহর ঘুরিয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে তারা পুলিশ সুপারের দপ্তরে আশ্রয় নেন।
পরে সেনাবাহিনীর সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে সাঁজোয়া যানে করে তারা গোপালগঞ্জ ছাড়েন। রাত পৌনে ৯টার দিকে এনসিপির নেতারা খুলনা সার্কিট হাউজে পৌঁছেছেন বলে দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহিন জানিয়েছেন।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: