সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকা দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। দুই দেশের সরকারের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই টানা পোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এটা যে যুদ্ধে গড়াবে, তা বোঝা যায়নি। অন্তত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বৃহস্পতিবার সকাল অবধি বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে দুই দেশের সীমান্তে সহিংসতা শুরু হয়। এর মধ্যে দিয়ে দুই দেশের দীর্ঘদিনের জমে থাকা উত্তেজনা এবার চরমে পৌঁছায়।
সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত অন্তত ১১ জন থাই নাগরিক নিহত হয়েছেন। থাইল্যান্ড তাদের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের দাবি জানিয়েছে।
দুই দেশের বিরোধের মূল কারণ কী
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিরোধের মূল কারণ শত বছরের পুরোনো উপনিবেশিক মানচিত্র নিয়ে মতবিরোধ। ফরাসিরা এক সময় কম্বোডিয়াকে উপনিবেশ করেছিল। সেই সময়ের সিয়াম (বর্তমান থাইল্যান্ড) ও কম্বোডিয়া উভয়ে ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্র তৈরি করেছিল। এতে ৫০৮ মাইল দীর্ঘ সীমান্তের সীমারেখা বিশেষ করে প্রাচীন মন্দিরগুলোর চারপাশে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
সীমান্তকেন্দ্রিক এই সীমারেখার বিভ্রান্তি ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গড়ায়। আদালত সিদ্ধান্ত দেয়, ১১শ শতাব্দীর প্রেহা বিহার মন্দিরটি কম্বোডিয়ার অংশ। থাইল্যান্ড এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হলেও মন্দির থেকে সরে যায়। তবে মন্দিরের আশপাশের এলাকাকে ঘিরে তাদের দাবি এখনও অব্যাহত রয়েছে।
২০০৮ সালে কম্বোডিয়া মন্দিরটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করে। এতে থাইল্যান্ড প্রবল আপত্তি জানায় এবং উত্তেজনা আবারও বাড়ে।
এরপর দুই দেশের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ ও কথার লড়াই শুরু হয়। এসব ঘটনায় প্রায় ২০ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ বাসস্থান হারায়। ২০১১ সালে কম্বোডিয়া আবারও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের দ্বারস্থ হয়। আদালত আবারও কম্বোডিয়ার পক্ষেই রায় দেয়। তবে সব বিতর্কিত এলাকায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয়নি। এর ফলে থাইল্যান্ড আদালতের এখতিয়ার মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
ব্যাংককে অবস্থানরত বিশ্লেষক ও এশিয়া হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার অ্যাডভোকেটসের পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, “কম্বোডিয়া আদালতে জিতেছে, আর থাইল্যান্ড তখন থেকেই এতে ক্ষুব্ধ। এই এলাকায় প্রাচীন মূল্যবান সামগ্রী আছে। আবার সীমান্ত বাণিজ্য নিয়েও সমস্যা রয়েছে। এসব ইস্যু সবসময়ই ছিল। কোনও পক্ষই চায় না এক ইঞ্চি জমিও ছাড় দিতে।”
সর্বশেষ সংঘর্ষের কারণ কী
২০১৩ সালের পর অঞ্চলটিতে সহিংসতা কমে গেলেও, গত মে মাসে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেসময় সীমান্ত সংঘর্ষে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হয়। এরপর থেকে সম্পর্ক ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যায়। উভয় দেশ উত্তেজনা কমানোর কথা বললেও সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়তে থাকে।
গত সপ্তাহে একটি বিস্ফোরণে তিনজন থাই সেনা আহত হন। তাদের একজন পা হারান। থাইল্যান্ড দাবি করে, এই মাইন কম্বোডিয়া সম্প্রতি পুঁতে রেখেছে। তারা আরও জানায়, মাইনটি রাশিয়ান তৈরি। আর এটি থাইল্যান্ডের অস্ত্রভাণ্ডারে নেই। কম্বোডিয়া এই অভিযোগ “ভিত্তিহীন” বলে অস্বীকার করে। তারা জানায়, এই অবিস্ফোরিত মাইনগুলো বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধের সময়কার অবশিষ্ট।
পরদিন বুধবার আরও পাঁচ থাই সেনা বিস্ফোরণে আহত হন। তাদের একজন পা হারান। এর জবাবে থাইল্যান্ড দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সব স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দেয়। তারা কম্বোডিয়ায় নিযুক্ত থাই রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনে এবং ব্যাংককে থাকা কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে।

বৃহস্পতিবার সকালে কম্বোডিয়া পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে এবং ব্যাংককে থাকা নিজেদের সব কূটনৈতিক কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। এরপর ঘোষণা দেয়, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।
কম্বোডিয়া আরও জানায়, তারা থাই সিনেমা ও টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। থাইল্যান্ড থেকে জ্বালানি, ফল ও শাকসবজি আমদানি বন্ধ করেছে। পাশাপাশি থাইল্যান্ডের কিছু আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সংযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও বয়কট করেছে।
বৃহস্পতিবার কী ঘটেছে
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই সংঘর্ষ মূলত এক হাজার বছরের পুরোনো খেমার-হিন্দু মন্দির ‘প্রাসাত তা মোয়ান থম’ এর আশপাশ জুড়ে ছিল। উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রথমে গুলি ছোড়ার অভিযোগ তুলেছে।
দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে প্রাসাত তা মোয়ান থমের পূর্ব দিকে প্রায় ২০০ মিটার দূর থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। থাই সেনারা জানায়, এর আগে তারা একটি ড্রোনের শব্দ শুনেছিল এবং ছয়জন সশস্ত্র কম্বোডিয়ান সেনাকে দেখতে পেয়েছিল। এরপর থেকে বিতর্কিত সীমান্তে অন্তত ছয়টি স্থানে চলমান সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
থাই সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, এই সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ও অনেকেই আহত হয়েছেন। তারা আরও জানায়, সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে কম্বোডিয়ার সেনারা থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশে দুটি বিএম-২১ রকেট নিক্ষেপ করে। এর ফলে ৮৬টি প্রদেশ থেকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে কম্বোডিয়ার কর্তৃপক্ষ জানায়, থাইল্যান্ডের গুলিতে তাদের দুটি প্রদেশ আক্রান্ত হয়েছে। এক মুখপাত্র বলেন, “আজ সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে থাইল্যান্ডের আগ্রাসী বাহিনী কম্বোডিয়ার সেনাদের উপর আগে গুলি চালায়… তারা যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ওয়াট কেও সিখা কিরিসভার রাস্তার ওপর দুটি বোমাও ফেলে। সেখানে আমাদের বাহিনী অবস্থান করছে দেশের সীমান্ত রক্ষায়।”
কম্বোডিয়ার দুটি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানতে থাইল্যান্ড এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। রয়্যাল থাই এয়ারফোর্স জানিয়েছে, সমস্ত বিমান নিরাপদে ফিরে এসেছে।
পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ কী শুরু হবে
বিশ্লেষকরা মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। কারণ অতীতে এমন গুলি বিনিময়ের ঘটনা কিছুদিনের মধ্যেই থেমে গেছে।
তবে তারা বলেন, গত কয়েক মাসের ঘটনা দুই দেশেই বিশেষ করে থাইল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়েছে। এই সংঘাত রাজনৈতিকভাবে থাইল্যান্ডে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। কারণ কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে তার কথোপকথনের একটি অডিও ফাঁস হয়ে গেছে। সেই ফোনালাপে তিনি নিজের সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেন এবং হুন সেনকে “কাকা” সম্বোধন করে অত্যন্ত বিনয় দেখান।
সিনাওয়াত্রা ও হুন সেন পরিবার পুরনো মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এই কেলেঙ্কারি এখন থাইল্যান্ডে সিনাওয়াত্রা পরিবারের তিন দশকের রাজনৈতিক আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনার ফলে থাই সরকার দুর্বল ভাবমূর্তি তৈরি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস–ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের সহযোগী গবেষক টিটা স্যাংলি বলেন, “কম্বোডিয়ার স্থাপন করা মাইন বিস্ফোরণে থাই সেনারা আহত হয়েছেন। এটি অটোয়া চুক্তির লঙ্ঘন। তার ওপর নতুন করে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটায় থাইল্যান্ডের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “সহনশীলতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। জনগণের আস্থার সঙ্কট তৈরি হতে পারে। তাই পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হবে বলে মনে হয় না। এখন মূল প্রশ্ন হলো, এই সংঘর্ষ কতদূর গড়াতে পারে।”
ফিল রবার্টসন বলেন, “এ মুহূর্তে কোনও পক্ষই আপস করতে প্রস্তুত নয়। আমার মনে হয়, লড়াই শুরু হয়ে গেছে। কোনও মধ্যস্থতা না হলে কেউই ছাড় দিতে চাইবে না। থাই সরকার এখনও হুন সেনের ফোনালাপ ইস্যু নিয়ে চাপে আছে। তাই দুর্বল দেখাতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, হুন সেন এই পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করছেন যাতে তার ছেলে ‘যুদ্ধকালীন নেতা’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। ছেলে এখনও তার বাবার ছায়া থেকে বের হতে পারেননি। পাশাপাশি এটি দেশের খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর কৌশলও হতে পারে।
রবার্টসনের মতে, হুন সেন ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা বাড়াচ্ছেন, যাতে তার ছেলে জনগণের সামনে একজন শক্তিশালী নেতারূপে উঠে আসতে পারে।
উভয় দেশের ওপরই চীনের প্রভাব রয়েছে। বেইজিং পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীন আশা করছে, উভয় দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে চায়।
এছাড়া ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের আঞ্চলিক সংস্থা আসিয়ানও হয়তো এই উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসবে।
তথ্যসূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ।