‘ইউনূসের স্বেচ্ছাচারিতার দায় বহুলাংশে সংবাদমাধ্যমের’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।

বাংলাদেশ ও বিশ্ব নিয়ে নিয়মিত লিখে আসছেন সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, যিনি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক হলিডে দিয়ে। এরপর সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে গেছেন কয়েকযুগ। সর্বশেষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে। সাম্প্রতিককালে সোশাল মিডিয়ায় ‘মিডিয়া ওয়াচ’ শিরোনামে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পাঠকের জন্য তার সর্বশেষ লেখাটি হুবুহু তুলে দেওয়া হলো।

বর্তমানে লন্ডন সফররত প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সফরের ফলাফল কী লজ্জাজনক তা আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন। এটা একটা কমপ্লিট ডিজাস্টার। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও প্রচার করা হচ্ছে সেখানে যেয়ে তিনি বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন। আমি গত তিন চার দিন ব্রিটিশ গণমাধ্যমে এটা নিয়ে কোন খবর দেখিনি। অন্যান্য দেশেও একই ঘটনা ঘটেছে।

দুঃখজনকভাবে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এই ডিজাস্টারের জন্য সিংহভাগ দায়ী ইউনূস নিজে এবং তার অনুগত প্রেস উইং। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে হাসিনা, মুনা নাইমুল ইসলাম খানদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।

প্রতিটা স্বৈরাচারী শাসকের আমলে বিদেশ সফর নিয়ে যে ধরনের কল্পকাহিনী আমাদেরকে বলা হত ইউনূস সাহেবের বেলায় সেই একই কথা প্রযোজ্য। আপনারা শুধু হাসিনার আমলের হাইকমিশনার মুনা তাসনিম এবং প্রেষ সচিব নাইমুল ইসলাম খানের জায়গায় বর্তমানে আবিদা ইসলাম এবং শফিকুল আলমের ছবি বসান। এবার দেখবেন সেই একই বয়ান সব জায়গাতেই। আমার দুঃখ হচ্ছে শফিক কি একবারও বুঝতে পারছে না যে তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে ইউনূস একের পর এক পাখি স্বীকার করে যাচ্ছেন; তাকে বলির পাঠা বানাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শফিককে নিয়ে যে ধরনের খিস্তি খাউর হচ্ছে সেটা দেখে আশঙ্কা করি এই সরকার চলে যাওয়ার পর শফিক হয়তো বাইরে নিরাপদে বের হতে পারবে না।

যেমনটা শিরোনামে বলেছিলাম যে এসবের জন্য মূলত দায়ী মেইনস্ট্রিম মিডিয়া। এরা যদি প্রথম থেকেই ইউনূসের এই অবৈধ কাজ গুলো নিয়ে প্রশ্ন করতো এবং বিদেশ ভ্রমণের ব্যয়, সফর সঙ্গী নিয়ে তার দপ্তর থেকে উত্তর আদায় করার চেষ্টা করত, তবে সে এতটা বেপরোয়া হত না।

ভাবতে অবাক লাগে যে লন্ডন সফরের আগে সাংবাদিকরা কেন মূল প্রশ্নগুলো করল না। যেমন এই সফর রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা দ্বিপাক্ষিক হলে ওখানে তাকে কীভাবে প্রটোকল দেওয়া হবে; কে তাকে রিসিভ করবে; দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কারা কারা থাকবেন ইত্যাদি। এর সঙ্গে সফর সঙ্গীর কারা হবেন এবং এতে মোট ব্যয় কত হবে সেটা অবশ্য করে দেশবাসীকে জানানো।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাংবাদিকরা এই প্রশ্নগুলো তো করেননি, উল্টো সরকারের প্রেস উইং থেকে দেওয়া বক্তব্যগুলো রিপোর্ট আকারে ছেপেছে বা টিভিতে প্রচার করেছে। যে রিপোর্টিং দেখে মনে হল এরা বিটিভি বা বিএসএস এ কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি এই সাংবাদিকরা কী লেখাপড়া একেবারেই করে না। তা না হলে কোনটা রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা দ্বিপাক্ষিক সফর এটা তারা জানবে না কেন? প্রথম আলোর মতো মর্যাদাপূর্ণ পত্রিকাও লিখছে রাষ্ট্রীয় সফর। কি দুর্ভাগ্য আমাদের!

ইতিমধ্যে জেনেছেন এটা কোনভাবেই রাষ্ট্রীয়, সরকারি বা দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল না। সেখানে পৌঁছানোর পর ইংল্যান্ডের কোন কর্মকর্তা তো দূরের কথা, কেউই ছিল না তাকে রিসিভ করার জন্য। তাকে রিসিভ করেছে বর্তমান হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। তার গদগদ চেহারা দেখে মনে হল যে তার জীবনে আর কিছু পাওয়ার নেই। ঠিক সাইদা মুনা তাসনিমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার লক্ষ্য করেছি।

যা হোক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করবে না এটা লন্ডনের ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা রিপোর্ট করেছে। এর কারণও উল্লেখ করেছে। আর সেটা হলো পাচারকৃত অর্থ ফেরত বিষয়ে আলাপ করার কোন ইচ্ছা কিয়ার স্টারমারের নেই।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি পশ্চিমা বিশ্বের যারা কর্ণধার তারা মোটামুটি সবাই দুর্নীতিবাজ এবং ধান্দাবাজ। তা না হলে পৃথিবীর যত লুটেরা এবং দুর্বৃত্তরা তাদের পাচার করা অর্থ সেসব দেশে নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন যাপন করে কীভাবে? আমেরিকার মতো দেশ যেখানে আইন কানুন খুব কড়া সেখানেও প্রতিবছর ৩০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়। বিশ্বাস না হলে ওয়াশিংটন পোস্ট ঘেঁটে দেখতে পারেন।

ওই সব দেশের পলিটিশিয়ানরা মোটামুটি এইসব অর্থ পাচারকারীদের জানি দোস্ত। এদের নির্বাচনের সময় এই পাচারকারীরা অনেক টাকা পয়সা দেয়। এ কারণে বুঝবেন যে কিয়ার স্টারমার কেন টিউলিপ সিদ্দিকীর বন্ধু হয়?

প্রশ্ন হল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক না করে ইউনূস সাহেব কেন সেখানে গেলেন ট্যাক্সপেয়ারের টাকা খরচ করে? এই সফরকে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ দেখানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে গেলেন দুদকের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা উচিত এই দুজন ছাড়া অন্যান্য সফর সঙ্গীদের যাওয়া-আসার ভাড়া; থাকা খাওয়াসহ সেখানকার যাবতীয় খরচ এখন ইউনূস নিজের পকেট থেকে দেবে না কেন?

ফেসবুক পোস্টে একজন লিখেছে, এপর্যন্ত ১১ বার তিনি বিদেশ গেছেন এবং সর্বমোট রাষ্ট্রের খরচ করেছেন ২৬০ কোটি আশি লাখ টাকা। যদিও আমার কাছে এটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তবুও সরকারের স্বচ্ছতার বিবেচনায় এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের এইসব ফালতু বিদেশ যাত্রার জন্য কত পরিমান টাকা খরচ হয়েছে এবং এগুলোর বেনিফিশিয়ারি কারা এটা জনগণকে জানাতে হবে।

এই সফরের মূল ব্যাপারটা ছিল ইউনূস সাহেবের ভাষায় সেখানে তিনি যাচ্ছেন রাজা চার্লসের কাছ থেকে কী একটা পুরস্কার নেওয়ার জন্য। পরে শুনলাম হারমোনি অ্যাওয়ার্ড; যেটার নাম কোনদিন শুনিনি। ফেসবুকে একজন লিখেছে ইউনূস সাহেব কি ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে জানেন? তা না হলে এই অ্যাওয়ার্ড তাকে দেবে কেন?

রাজা চার্লসের একটা কুকীর্তি আপনাদের মনে করিয়ে দেই। সিংহাসনে বসার আগে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে একটা সফরে যান। সেখানে তাকে একটা ব্রিফকেস উপহার দেওয়া হয় যার মধ্যে ছিল ক্যাশ টাকা। ব্যাপারটা জানাজানি হলে চার্লসকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করে এ ব্যাপারে। সে আমতা আমতা করে বলে এর মধ্যে যে এত ক্যাশ ছিল এটা তো আমি বুঝতে পারিনি।

এই হচ্ছে ব্রিটিশ পলিটিশিয়ান এবং রাজা রাজড়াদের চরিত্র। এরা যে এককালে আমাদের শোষণ করেছে এবং আমাদের দেশকে লুটে আমাদের গরিব বানিয়েছে এটা আমরা ভুলে যাই কেন। এরা তো সবাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বংশধর। দুঃখজনকভাবে এই লুটেদারদের দেখলে এখনো আমরা পোশাক কুকুরের মতন লেজ নাড়তে থাকি। তাদের মত সুট টাই পরে, ইংরেজি না বলতে পারলে আমরা তো মানুষই হতে পারলাম না। কী দুর্ভাগ্য এ জাতির!

এ সংক্রান্ত আরও খবর:

আরও পড়ুন