শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ে ‘নিরুদ্দেশ’ আওয়ামী লীগের নেতারা। গ্রেপ্তার আতঙ্ক তো আছেই, সঙ্গে নানা কেলেঙ্কারি সামনে আসছে একে একে! বদলে গেছে মোবাইল ফোনের নম্বরও। কেউ দিব্যি আছেন; কেউবা গুণছেন ফেরার দিন। কিন্তু তারা কে কোথায় আছেন?
শীর্ষ স্থানীয় বেশিরভাগ নেতাকর্মী ভারতে আশ্রয় নিলেও কে কোথায় আছেন তা নিয়ে ছিল ধূম্রজাল। এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে নেতাদের অবস্থান। শুধু প্রতিবেশী ভারতই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা।
দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে আছেন সেটা অজানা নয়; তিনি ভারতের আতিথেয়তায় রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় দিল্লিতেই আছেন সেটাও সবাই কমবেশি জানে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্তত দুইজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য সান ২৪কে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে থাকা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বর্তমানে দিল্লিতেই আছেন, তবে সেটি ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায়।
আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন না তিনি।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক আছেন কলকাতায়।
প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে, বাহাউদ্দীন নাছিম ও মাহবুব-উল-আলম হানিফ কলকাতায় আত্মগোপনে আছেন।
কলকাতায় আছেন আরও অনেকেই। কেউ প্রকাশ্যে, আবার কেউ আত্মগোপনের পথই বেছে নিয়েছেন। কাউকে কাউকে দেখা গেছে নিয়মিত আড্ডায়; বিপণিবিতানে, রেস্তোরাঁয়, আবার কেউ ঘরবন্দি থাকছেন।
সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম, লিয়াকত শিকদার, সাবেক সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ, সাইফুজ্জামান শিখর, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান কলকাতায় আছেন।
দেশত্যাগ করা অন্তত দেড় ডজন নেতার সঙ্গে দ্য সান ২৪– এর পক্ষ থেকে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়েছে। বলেছেন, ভালো আছেন; ফেরার দিন গুণছেন।
মার্চের মধ্যেই দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। গণমানুষের সমর্থন নিয়েই আওয়ামী লীগ সকল অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। — শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছেন, আর উপ দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান কলকাতায় রয়েছেন।
বেশিরভাগই কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও যশোরের বিভিন্ন সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় পৌঁছান বলে সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন নিশ্চিত করেছেন। পরে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে চলে যান।
৭ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্টের মধ্যে বেশিরভাগ নেতারা দেশ ছাড়েন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। একমাত্র ওবায়দুল কাদের নভেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশেই ছিলেন।
সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল কলকাতায়, সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী লন্ডনে, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত আমেরিকায়, সাবেক নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাবেক হুইপ আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন লন্ডনে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হয়েছে দ্য সান ২৪।
সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দুবাই, আলাউদ্দিন নাছিম কানাডায়, আ ক ম বাহা উদ্দিন বাহার, নাহিম রাজ্জাক ও অনুপম শাহজাহান জয় কলকাতায় অবস্থান করছেন।
এছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমদ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসীন বাহার সূচনাও কলকাতায় আছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব ও রনজিত সরকারও একই শহরে অবস্থান করছেন; কথা হয়েছে তাদের সঙ্গে।
সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল ও শেখ তন্ময় ছাড়াও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শেখ ফাহিম সপরিবারে কলকাতায় অবস্থান করছেন।
অন্যদের মধ্যে, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ পরশ কানাডায়, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান নিখিল কলকাতায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজি মেসবাউল হোসেন সাচ্চু ও সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু কলকাতায় অবস্থান করছেন।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুল হাসান রিপন ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন কলকাতায় থাকছেন।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ কলকাতায় থাকলেও তার কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম রয়েছেন লন্ডনে।
দেশের বাইরে থাকা স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা জানান, ৪ আগস্ট রাত থেকেই অনেকে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করেন এবং ৫ তারিখের পর থেকে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন তারা।
আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের এভাবে একা ফেলে দেশান্তরী হওয়াকে কীভাবে দেখছেন- জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের কাছে, যিনি নিজেও দেশান্তরী।
তিনি বলেন, “৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে।”
তবে দেশের বাইরে থাকলেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে দাবি করেন নাদেল।
ফেব্রুয়ারির মধ্যেই দল গোছানোর কাজ শেষ হবে জানিয়ে তিনি দাবি করেন, “মার্চের মধ্যেই দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। গণমানুষের সমর্থন নিয়েই আওয়ামী লীগ সকল অন্যায়,অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে।”
আওয়ামী লীগের মধ্যে জনপ্রিয় এই নেতা বলেন, দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে তা এখন দিবালোকের মতো স্পট। বর্তমান অবৈধ দখলদার ইউনূস নিজেও স্বীকার করেছেন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সবকিছু করা হয়েছে।
“এই অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত গঠনসহ দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছেও এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়েছে।”
আন্তর্জাতিক জনমত এখন আওয়ামী লীগের পক্ষে বলেই তার দাবি।