প্রতিটি সফলতার পেছনে কত যে দুঃখগাথা থাকে, কত যে অব্যক্ত বেদনা লুকিয়ে, সে খোঁজ কয়জনই বা রাখে? সফলতার পরতে পরতে ব্যর্থতার হাতছানি! তাও কেউ কেউ সব বাধা ডিঙিয়ে শুধু একান্ত নিজের প্রচেষ্টা ও আত্মবিশ্বাসের জোরে এগিয়ে যায়। এমনই এক গল্প পোল্যান্ডে অভিবাসী এক বাংলাদেশির।
পুরো নাম এহসান মুত্তালিব ইমন। প্রায় দুই যুগ আগে শূন্য হাতে পোল্যান্ড এসেছিলেন মায়ের দিকের এক আত্মীয়র হাত ধরে। অথচ দেশ ছাড়ার স্বপ্ন কখনই দেখেননি তিনি। নিতান্ত অপারগ হয়ে দেশান্তরী হওয়ার সিদ্ধান্ত।
“আমার সামনে কোনো পথ খোলা ছিলো না। ‘কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো তখন। বাবা-মায়ের মন রক্ষার্থে ভর্তি হয়েছিলাম কম্পিউটার সায়েন্সে। অবশ্য আমার ইচ্ছে ছিলো ব্যবসায়ে প্রশাসনে পড়বো। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে অনুমোদন না নেওয়ায় হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কালো তালিকাভুক্ত করে ফেললো ইউজিসি। আমি তখন থার্ড ইয়ারে,” বলছিলেন মিস্টার মুত্তালিব।
এরপর পড়াশোনার উপর থেকেই মন উঠে যায় তার। যেখানে এক বছরের মধ্যে ‘গ্র্যাজুয়েট’ হয়ে বের হওয়ার কথা, সেখানে নতুন করে শুরু করতে মন সায় দেয়নি কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়া, এসএসসিতে স্টার, আর এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ পাওয়া সেই তুখোড় ছাত্রের।
“হঠাৎ করেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন! কী করবো, কোনো পরিকল্পনাই করতে পারছিলাম না। শেষে পোল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা মায়ের দিকের ওই আত্মীয়ের শরণাপণ্ন হলাম। তিনি বোঝালেন, বিদেশের জীবন কতোটা কঠিন।
“আমি নাছোড় বান্দা,” হাসতে হাসতে বলছিলেন মুত্তালিব।
পোল্যান্ডের সিলিজিয়া প্রদেশে বর্তমানে মুত্তালিব তিনটি ইন্ডিয়ান, একটি থাই ও একটি কাবাবের রেস্তোরাঁর মালিক। সঙ্গে রয়েছে একটি বাংলাদেশি খাবারের দোকান।
তবে এ অবস্থায় পৌঁছুতে তার কতটা কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে সে গল্প না বললেই নয়।
মুত্তালিব জানান, ওই আত্মীয়ের বদৌলতে তিনি পোল্যান্ড চলে আসেন ২০০২ সালে। ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর সেই আত্মীয়ের রেস্তোরাঁয় কাজ করতে হয়েছে তাকে। ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি রেস্তোরাঁর নানা কাজের অভিজ্ঞতা তিনি সেখান থেকেই অর্জন করেন।
প্রবাস জীবনের একাকিত্ব মানুষকে পরিণত করে তুলে, যার প্রমাণ বর্তমানের এই ব্যবসায়ী।
“এর মাঝে এক পোলিশ মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম। চুটিয়ে প্রেম করলাম কয়েকবছর, তারপর ২০০৮ সালে বিয়ে,” খুব আগ্রহ নিয়ে স্ত্রীর গল্প বলছিলেন মুত্তালিব।
এই ‘পোলিশ-বাংলাদেশি দম্পতির ঘরে এখন তিন সন্তান, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। জানালেন সুখেই আছেন।
মুত্তালিবের কঠিন সময়
২০১০ সালে মুত্তালিব তার আত্মীয়ের দোকান ছেড়ে দেন খানিকটা অভিমান করেই। লক্ষ্য ছিলো- এবার নিজের জন্য কিছু করা। আর সেই থেকে বিদেশের মাটিতে প্রকৃত লড়াই যেমন শুরু, তেমনি চললো নিজের ‘ব্যবসায়ে প্রশাসনে’ না পড়ার অপূর্ণতাকে নতুন রূপে ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টা।
“দুই বছর আরেকটি রেস্তেরাঁয় কাজ করি। কারণ খাবার তৈরি শেখা ছাড়া আমার পক্ষে শেফকে বেতন দিয়ে রেস্তোরাঁ চালানো সম্ভব ছিলো না। কপর্দকশূন্য আমি। কাজ শিখলাম,” ধরা গলায় বলছিলেন তিনি।
এরপর ২০১২ সালে বাবা-ভাইয়ের আর্থিক সহায়তা ও নিজের জমানো সব মিলিয়ে মাত্র ২০ হাজার ইউরো দিয়ে চালু করেছিলেন রেস্তোরাঁ। তখন রান্না থেকে সব কাজই নিজ হাতে করতে হতো তাকে।
“বাধ সাধলো তখনই যখন দেখলাম একদিন রান্না ভালো হচ্ছে, তো পরেরদিন খারাপ। ব্যবসা ভালো যাচ্ছিলো না। এমনও ভেবেছি সব ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ড চলে যাই বউকে নিয়ে,” যোগ করেন ততদিনে পোল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়া মুত্তালিব।
মাসালা হাউজ ছিলো তার ইন্ডিয়ান খাবারের প্রথম রেস্তোরাঁ।
২০১৪ সালে ভারত থেকে তিনি নিয়ে আসেন একজন পেশাদার শেফ। এরপর থেকে তাকে আর ঘুরে তাকাতে হয়নি। ২০১৬ সালে চালু করেন থালি হাউজ বাই মাসালা হাউজ নামে দ্বিতীয় ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ।
অবশ্য নিজের অর্থায়নে নয়। বিনিয়োগের ১ লাখ ইউরোর অর্ধেকই তিনি পেয়ে যান ব্যাংক ঋণ হিসেবে। ২০১৮ সালে একটি শপিং মলে চালু করেন তৃতীয় রেস্তোরাঁ- মাসালা হাউজ এক্সপ্রেস। খরচ পড়েছিলো দেড় লাখ ইউরোর মতো, যার মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার ইউরোই ছিলো ঋণ।
তিনি জানান, পরিচ্ছন্ন আয়কর ‘রেকর্ডের’ বদৌলতে তাকে কখনই ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে বেগ পেতে হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাহিদার চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়ার ‘মধুর চাপও’ নিতে হয়েছে তাকে।
মূলত মুনাফার সঙ্গে ঋণের অর্থ জোড়া দিয়ে রেস্তোরাঁ খুলতেন তিনি।
অবশ্য ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে ২০২৪ সালে মাসালা হাউজ এক্সপ্রেস বন্ধ করে দিয়ে তিনি দমরবা গুরনিছা শহরে চালু করেন তার সবচেয়ে বড় রেস্তোরাঁ থালি হাউজ।
এর আগে ২০২৩ সালে খুলেন বাংলাদেশের খাবার বাংলাদেশি শপ অ্যান্ড ডাইন। ২০২৪ সালে কাবাবের রেস্তোরাঁ ইউরো এশিয়া।
আপাত দৃষ্টিতে এহসান মুত্তালিব ইমনের ইর্ষণীয় ব্যবসায়িক সাফল্যের পথ বেশ মসৃণ দেখালেও করোনা মহামারির সময় ভেঙে পড়েছিলো তার ব্যবসা।
বর্তমানে ৪৮ জন কর্মী নিয়ে তার ‘ব্যবসার সংসার’। যাদের অধিকাংশই ভারতীয়। এছাড়া পোলিশ, থাই এবং বাংলাদেশিও রয়েছেন। ভোক্তাবান্ধব পরিবেশ, সুস্বাধু খাবার আর দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে।
মুত্তালিবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, দেশ হিসেবে পোল্যান্ড কেমন?
একটু সময় নিয়ে বললেন, “দেখুন, সব দেশেরই কিছু নিয়ম-কানুন আছে। নিয়ম মেনে চললে পৃথিবীর কোনো দেশই বসবাসের অযোগ্য নয়। সে হিসেবে পোল্যান্ড অবশ্যই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চমৎকার। বিশেষ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকার জন্য এর চেয়ে প্রবাসীবান্ধব দেশ হয় কিনা জানি না!”
জানালেন, বাচ্চাদের বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ থেকে শুরু করে শিশুর জন্য প্রতিমাসে ২০০ ইউরো বরাদ্দ রয়েছে রাষ্ট্রের, যা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত চালু থাকে।
এছাড়া নাগরিক হয়ে গেলে পাওয়া যায় বেকারভাতাসহ অন্যান্য সার্বজনীন ভাতা।
কথায় ও কাজে বেশ চটপটে এহসান মুত্তালিব ইমন। চলে আসার আগে তিনি একটি পরামর্শ দিয়ে বললেন, বাংলাদেশিরা বেশ পরিশ্রমী। তবে অনেকের মধ্যেই ধৈর্য্যের দেখা মেলে না, সততার অভাব, এবং শর্টকাটে বড় হওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায়।
এসব বিষয়ে মনযোগী হতে পারলে বিদেশে বাংলাদেশিদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।
প্রচেষ্টা আর সততার জোরে কীভাবে সফলতা পাওয়া সম্ভব তার উদাহরণ শুধু মুত্তালিব নন, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লাখো বাঙালি। তারাই আমাদের অনুপ্রেরণা।