দ্রোহের দিনলিপি: গোপালগঞ্জের শেখ আজিজের কষ্টগাঁথা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙ্গে ফেলা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এরকম সকল প্রতিকৃতি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙ্গে ফেলা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এরকম সকল প্রতিকৃতি।

বাংলাদেশে গেল বছর সরকার পরিবর্তনের পর বহু রাজনৈতিক কর্মী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তথ্যেও এমনটি উঠে এসেছে। ঘরহারা, পরিবারহারা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিরোধীদের নির্যাতনে জেরবার কতশত মানুষ, যারা আজ পথের মাঝেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন বা নিতে বাধ্য হয়েছেন। সে গল্প বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অবশ্য অনুপস্থিত! এর মাঝেও কেউ কবি হয়েছেন, কেউ লেখক, কেউবা দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর। এমনই একজনের গল্প থাকছে আমাদের সাপ্তাহিক আয়োজন দ্রোহের দিনলিপিতে। আজকের গল্প গোপালগঞ্জ জেলা যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক শেখ আজিজ রহমানের। সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন তিনি নিজেই।

৬ নভেম্বর ২০২৪, আমার জীবনের স্মরণীয় দিন। বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বের হলাম মেয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করার জন্য। নিরাপত্তার প্রয়োজনে নিজে শহরে না যেয়ে ভাইয়ের ছেলের সাথে মেয়েকে পাঠালাম। আমি কামাল স্টেডিয়ামে আলমের চায়ের দোকানে বসে আছি। এরমধ্যে সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনীর ১০-১২টি গাড়ি আসলো। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে তুলে নিয়ে গেল ওদের গাড়িতে। কোনো অপরাধ বা মামলা ছাড়াই আমাকে আটক করলো তারা।

গাড়িতে তুলেই আমার হাত ও চোখ বেঁধে ফেলা হয়। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নেওয়ার আগে তিনবার গাড়ি থামে। প্রত্যেকবারই আমাকে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে তথ্য বের করার চেষ্টা করে। সেই সাথে অন্যান্য নির্যাতন তো ছিলই। এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা তাদের সাথে গাড়িতে ঘুরতে থাকি। পরে ক্যাম্পে নিয়ে গ্রিলের সাথে হাত বেঁধে শুরু হয় ১০-১২ জন মিলে অমানবিক নির্যাতন। খাওয়ার জন্য একটু পানি চাইলেও তারা তা দেয়নি। নির্যাতনের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে, এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জ্ঞান ফিরলে তারা আমার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। তখন আমার প্রেসার লো হয়ে যায়। এতকিছুর মধ্যেও আবার তারা আমার উপর নির্যাতন শুরু করে। আর সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করে যাচ্ছিল।

রাত ১টার দিকে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় আবার তারা আমাকে তাদের গাড়িতে তুলে। তখনও জানি না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর তারা আমাকে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানে জোর করে চিকিৎসকের কাছ থেকে আমার শারীরিক সুস্থতার সার্টিফিকেট নেয়া হয়। পরে আবারও সেই আতঙ্কের গাড়ি ভ্রমণ। এবারের গন্তব্য সদর থানা। গভীর রাতে তারা আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আমাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে চলে যায়।

দীর্ঘ ১১৩ দিন পর কারামুক্ত হলেও বাড়িতে থাকার সুযোগ আর হয় না। সারাক্ষণই একটা আতঙ্ক নিয়ে সময় পার করি। পরিবার থেকে দূরে, অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে পারি না, সন্তানদের আদর করতে না পারা; এসব যন্ত্রণা লিখে বোঝানো সম্ভব না। — শেখ আজিজ রহমান

থানায় থাকা অবস্থায় আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাতেই থানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা আবার আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আমার চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি রাখতে চাইলেও পুলিশ আমাকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে দেয়নি। পরে আবারো পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানায় নিয়ে আসা হয় আমাকে। থানায় নিয়ে আমাকে গারদে রাখা হলো। গারদে পেলাম স্বাধীন ও সাকিব নামে দুই রাজনৈতিক সহকর্মীকে। এভাবেই কখন যে রাত পার হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। ফজরের আজানের সাথে সাথেই আত্মীয়দের নিয়ে থানায় হাজির আমার মেয়ে।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমাকে থানা থেকে আদালতে নেয়া হয়। সেখানে আমাকে রাখা হয় আদালতের গারদে। সেখানে রাজনৈতিক ছোটভাই মিলনের সাথে দেখা হয়। মিলনই আমাকে সেখানে সেবা শুশ্রূষা করে। সারাদিন পরে সন্ধ্যার দিকে আমাকে আদালত থেকে জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। জেল গেটে ডাক্তররা আমার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমার সাময়িক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। অথচ তখন আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি।

জেলখানায় রাজনৈতিক সহযোদ্ধা তুহিন মামা, মাহমুদ মামা, মিলন, তৌফিক মামা, সিদ্দিক ভাই, দ্বীন ইসলাম, চাঁন মিয়া, আনিস, এবাদুল, নয়নসহ আরও অনেককেই পেয়ে যাই। তাদের সার্বক্ষণিক পরিচর্যা আর সেবায় ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হতে থাকি। কারাগারে পুরো দুইটা মাসই ছিলাম অসুস্থ। এরইমধ্যে জেলখানায় আসে হিটু ভাই, তরিকুল, বাবু, রাজু ভাই, রাশেদ, মোস্তাক, শাহনেওয়াজ, জাবেদ ভাই, বেলায়েত কাকা, খায়রুল ভাই, মাহাবুব ভাই, বাপ্পি ভাডি, লাচ্চু শরিফসহ আরও অনেকে। তাদের কথা কখনোই ভুলবার নয়। একপর্যায়ে খবর পাই, সেনাবাহিনীর করা মামলায় আমার জামিন হয়েছে। জামিন নিয়ে বের হওয়ার সময় জেলগেটেই নতুন মামলায় আমাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই কেটে যায় ১১৩ দিন।

দীর্ঘ ১১৩ দিন পর কারামুক্ত হলেও বাড়িতে থাকার সুযোগ আর হয় না। সারাক্ষণই একটা আতঙ্ক নিয়ে সময় পার করি। পরিবার থেকে দূরে, অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে পারি না, সন্তানদের আদর করতে না পারা; এসব যন্ত্রণা লিখে বোঝানো সম্ভব না।

এতকিছুর পরেও, পরিবার ছেড়েছি, ঘর ছেড়েছি কিন্তু দল ছাড়িনি। একাত্তরের বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আমার বড় ভাইসহ তিন চাচা শহিদ হন। যতদিন বেঁচে আছি বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ আর প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার আদর্শকে ধারণ করেই বেঁচে থাকবো ইনশাআল্লাহ।

জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

হৃদয়ে জমে আছে কষ্ট, কোনো শোকগাঁথা কিংবা অপ্রকাশিত আর্তনাদ? নির্ভয়ে লিখুন আমাদের দ্রোহের দিনলিপিতে। email: [email protected]

আরও পড়ুন