আফগানিস্তান কি নারীদের জন্য নরক হয়ে উঠছে?

মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা নীল রঙের ঢিলেঢালা বোরকার মতো পোশাক পরছেন নারীরা। ছবি: রয়টার্স ভায়া বিডিনিউজ।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা নীল রঙের ঢিলেঢালা বোরকার মতো পোশাক পরছেন নারীরা। ছবি: রয়টার্স ভায়া বিডিনিউজ।

গেল ১৫ আগস্ট তালেবান শাসনের চারবছর পূর্ণ হলো আফগানিস্তানে। এই সময়ের মধ্যে দেশটিতে নারীদের অধিকারে কতোটা কাটছাঁট হয়েছে তা বুঝতে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি থেকে বেশ আঁচ করা যায়। তালেবানের প্রথম শাসনামলে নারীদের জন্য যা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো, বর্তমানে সময়ে এসে তাকে কেউ কেউ নারীদের নরকের সঙ্গে তুলনা করছেন।

পরিস্থিতি যখন এমন অসহনীয় জাতিসংঘের নারী সংস্থা ইউএন উইমেন সতর্ক করে বলেছে, জরুরি পদক্ষেপ না নিলে এই অসহনীয় বাস্তবতাই হয়তো একদিন স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হবে, আর নারী ও কন্যাশিশুরা হবে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত।

ইউএন উইমেন এক বিবৃতিতে বলেছে, “তালেবান এখন এমন এক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যেখানে নারীদের সম্পূর্ণভাবে জনজীবন থেকে মুছে ফেলা হবে।”

ইউএন উইমেনের এই সতর্কবার্তা এসেছে এমন সময়ে, যখন আফগানিস্তানে জাতিসংঘ সহায়তা মিশন (ইউএনএএমএ) তাদের সর্বশেষ মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এতে বলা হয়, মে থেকে জুনের মধ্যে নারীদের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং নারী মানবিককর্মীদের হত্যার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে অহরহ।

নারীদের ও কন্যাশিশুদের অধিকার সীমিত করতে তালেবান যে সব ফরমান জারি করেছে, সেগুলো একে অপরের সঙ্গে মিলে এমন এক অচলাবস্থা তৈরি করেছে যা নারীদের গৃহবন্দী জীবনে ঠেলে দিচ্ছে এবং তাদের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, মানবিক সহায়তাকর্মীদের ক্ষেত্রেও, নারীদের জনসম্মুখে অবাধ চলাফেরার অনুমতি নেই যদি না তাদের সঙ্গে কোনো মাহরাম বা পুরুষ অভিভাবক থাকে।

ইউএনএএমএ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে মাহরাম সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পরিবর্তন এসেছে।

তালেবান কর্তৃপক্ষ বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে যেন তারা মাহরাম ছাড়া আসা কোনো নারীকে সেবা না দেয়।

কিছু অঞ্চলে কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে হিজাব বিধি কার্যকর করতে শুরু করেছে, যেখানে নারীদের পুরো শরীর ঢেকে রাখার জন্য চাদর পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হেরাতে, যারা এই নিয়ম মানছে না, তাদের জনসমাগমস্থলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।

নারীদের জনসম্মুখে চলাফেরায় বাধা দেওয়ার পাশাপাশি, তালেবান নারী ও কন্যাশিশুদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা থেকেও নিষিদ্ধ করেছে।

এই দুটি ফরমান মিলিয়ে সমাজের সব স্তরে গভীর প্রভাব ফেলছে। এখন শুধু যে নারীদের জন্য শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে তাই নয়, তাদের জন্য চাকরি পাওয়া বা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়াও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

ফলস্বরূপ, আফগানিস্তানের ৭৮ শতাংশেরও বেশি নারী বর্তমানে শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছে।

এর অর্থ হলো, দেশের কর্মশক্তির প্রায় অর্ধেকই অর্থনীতিতে দৃশ্যমানভাবে কোনো অবদান রাখছে না, যা একটি বিশাল সংকট এমন এক দেশের জন্য, যার অর্থনীতি নানা নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত।

ইউএনএএমএ’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তালেবান কর্তৃপক্ষ বারবার দাবি করছে যে ইসলাম নারীদের কাজ করার অনুমতি দেয়, যদিও তাদের জারি করা ফরমানে নারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

কেবল অর্থনীতিই নয়, এই ফরমানগুলো অনেক ক্ষেত্রে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও তৈরি করছে।

জাতিসংঘের নারী সংস্থা বলেছে, “এর ফলাফল ভয়াবহ। নারীরা আরও অল্প বয়সে মারা যাচ্ছে এবং অসুস্থতাপূর্ণ জীবনযাপন করছে।”

উদাহরণস্বরূপ স্বাস্থ্যখাতের কথা ধরা যাক। যদি নারীদের উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া হয়, তবে তারা চিকিৎসক হতে পারবে না। আর যদি কিছু অঞ্চলের মতো নারীদের পুরুষ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়, তবে তাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ নেই।

ইউএন উইমেনের হিসাব অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবায় বাধার কারণে আফগানিস্তানে মাতৃমৃত্যুর হার ২০২৬ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

শিশুবিবাহও ক্রমেই বাড়ছে, এবং নারীরা ঘরের ভেতরে ও বাইরে ক্রমবর্ধমানভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে, জোরপূর্বক বিয়ে কার্যকর করার সঙ্গে তালেবান কর্তৃপক্ষ নিজেরাই জড়িত বলে প্রমাণ মিলেছে।

তালেবানের এক ফরমানে নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছবি: ইউনিসেফ থেকে নেওয়া।

কেবল জনসম্মুখেই নয়, ঘরের ভেতরেও নারীদের কণ্ঠস্বর উপেক্ষিত হচ্ছে। ৬২ শতাংশ নারী মনে করেন, তারা ঘরোয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণেও কোনো প্রভাব ফেলতে পারেন না।

ইউএনএএমএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পরিস্থিতি এমন এক সময়ে ঘটছে যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ছে; অনেক বেসরকারি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হিসাবগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

ইউএন উইমেন বলছে, আশার অবকাশ প্রায় না থাকলেও আফগান নারীরা স্থিতিশীল ও দৃঢ় রয়েছেন। তারা এখনও ভিন্ন এক ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় বেঁচে আছেন।

গত মে মাসে, জাতিসংঘে কর্মরত কিছু নারী তাদের কাজের কারণে সরাসরি হত্যার হুমকি পেয়েছিলেন, তবুও তারা জীবনরক্ষাকারী ও জীবনগঠনমূলক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

নারীদের নিয়ে কাজ করা একজন আফগান মানবাধিকার কর্মী বলেন, “আমি একজন নারী হিসেবে দৃঢ়ভাবে আফগান নারীদের পাশে থাকব। আমি দূরবর্তী এলাকায় যাই, তাদের গল্প সংগ্রহ করি, তাদের সমস্যার কথা শুনি। এতে তারা আশা পায়। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি, আর এটিই আমাকেও আশা জোগায়।”

সবমিলিয়ে, ২০২১ সালের পর থেকে নারীদের ও কন্যাশিশুদের সামাজিক চলাচল সীমিত করার জন্য প্রায় ১০০টি ফরমান জারি ও কার্যকর করা হয়েছে। চার বছরে এর একটিও বাতিল করা হয়নি।

চার বছর আগে ক্ষমতা গ্রহণ করেই নারীদের চলাফেরা নিয়ে একগুচ্ছ বিধিনিষেধ ঘোষণা করে দেশটির শাসকগোষ্ঠী। এরপর কাবুল থেকে শুরু করে দেশটির অন্য শহরগুলোর রাস্তায়, বাজারে নারীর উপস্থিতি কমতে থাকে। এখন তা শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে।

নারীদের প্রতি তালেবানের এসব কড়াকড়ি বিধিনিষেধের প্রতি ইঙ্গিত করে নওশিন নামের এক অধিকারকর্মী বিবিসিকে বলেন, “প্রতি মুহূর্তে নিজেকে মনে হবে কারাগারে আছেন। এমনকি নিঃশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত এখানে কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

নারী অধিকার কেড়ে নেওয়া ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে চাপে থাকলেও খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না তালেবান সরকার।

রাজধানী কাবুলের মতো শহরগুলোতে রাস্তায় অল্পসংখ্যক নারীদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই কালো অথবা গাঢ় নীল রঙের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ঢিলেঢালা বোরকার মতো পোশাক পরে থাকেন। অধিকাংশের পুরো মুখমণ্ডল ঢাকা থাকে, শুধু চোখ দেখা যায়। 

তবে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে আফগান নারী ও মেয়েরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। কিছু আফগান নারীকে প্রতিবাদী ভিডিও পোস্ট করতেও দেখা যায় সোশাল মিডিয়ায়।

আফগানিস্তানে ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি সুসান ফার্গুসন বলেছেন, এ অগ্রগতির অভাবকে কেবল আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত নয়।

তিনি বলেন, “এটি শুধু আফগান নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়। এটি আসলে আমরা বৈশ্বিক সম্প্রদায় হিসেবে কীসের পক্ষে দাঁড়াই, তা নিয়েও।”

“যদি আমরা আফগান নারী ও কন্যাশিশুদের কণ্ঠরোধ হতে দিই, তবে আমরা আসলে এই বার্তাই দিই যে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে নারীদের ও কন্যাশিশুদের অধিকার অগ্রাহ্যযোগ্য। আর সেটি একটি ভয়াবহ নজির।”

ক্ষুধা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, চিকিৎসাহীনতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধুঁকতে থাকা তালেবান সরকার নারীদের কতদিন কত দূর পর্যন্ত কণ্ঠরোধ করে রাখতে পারবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। তবে অবরোধবাসী হয়ে পড়া আফগান নারীরা যে সহসা তালেবানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারছেন না, তা স্পষ্ট।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, ইউএন উইমেন, রয়টার্স

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন