দক্ষিণ আমেরিকার শহর বলতে যেমন বোঝায় তেমনই সাজানো গোছানো ছিমছাম একটি শহর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যের কেনেশ’। বাকিসব ছোট শহররে মতো এই শহরটিতেও বেকারিগুলো থেকে বিস্কুটের সুগন্ধ ভেসে আসে; আর শোনা যায় ট্রেনের কু ঝিঁক ঝিঁক।
শহরটির ক্যাফেগুলো এখনও শান্ত, যেখানে নিরিবিলি পরিবেশে একান্তে সময় কাটিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে হাতে লেখা চিরকুট ছেড়ে আসে নবদম্পতিরা।
তবে এই শান্ত নিরিবিলি শহরটির রয়েছে চমকপ্রদ একটি আইন। যা শুনলে চোখ কপালে উঠে যায় অনেকেরই। জানেন কী সেই আইন?
শুনলে অবাক হবেন এই শহরের বাসিন্দাদের প্রত্যেকের অস্ত্র ও গুলি রাখা বাধ্যতামূলক। আশির দশকে অস্ত্র ও গুলি রাখার এ আইন করা হয়।
শহরটির মেয়র দেরেক ইস্টারলিং বলেন, এর মানে এই নয় যে ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মতো সবাই কোমরে অস্ত্র গুঁজে ঘুরছে।
‘স্বঘোষিত’এই নৌবাহিনীর সদস্য তিন মেয়াদ ধরে শহরটির মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বলেন, “আমরা দরজায় দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে বলি না যে আমাকে তোমার অস্ত্র দেখাও।”
কী বলে কেনেশ’ এর অস্ত্র আইন?
আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শহরের সীমানার মধ্যে বসবাসরত প্রতিটি পরিবারের প্রধানকে শহর এবং এর বাসিন্দাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং সাধারণ কল্যাণের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে একটি অস্ত্র এবং তার সঙ্গে গোলাবারুদ রাখতে হবে।
তবে মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধী, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত বা দ্বন্দ্বমূলক ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিকারী বাসিন্দাদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য হবে না।
মেয়র ইস্টারলিং ও একাধিক স্থানীয় কর্মকর্তা জানান, ১৯৮২ সালে আইনটি প্রণয়নের পর থেকে এ পর্যন্ত আইনের অপব্যবহারের দায়ে কোনো বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি।
তবে আইনটি ভঙ্গ করলে কী সাজা হবে তাও কেউ জানে না।
তবুও মেয়র জোর গলায় বললেন, “এটি কোনো প্রতীকী আইন নয়। আমি শুধু দেখানোর জন্য কিছু করি না।”
এদিকে আইনটিকে গৌরবের প্রতীক এবং শহরের অস্ত্র সংস্কৃতির স্বীকৃতির চিহ্ন হিসেবেও দেখেন শহরের কিছু বাসিন্দা।
অনেকে আবার এটিকে ইতিহাসের লজ্জাজনক প্রতীক মনে করে এই ইতিহাসকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চান। তবে যে ধারণাটি সবচেয়ে মজবুত তা হলো এই অস্ত্র আইন তাদের শহরকে নিরাপদে রেখেছে।
কেনেশ’ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট জানায়, ২০২৩ সালে দুইটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেও গুলিতে কেউ খুন হননি।
কেনেশ’ ব্যাপিস্ট চার্চের গ্রাউন্ডকিপার ব্লেক ওয়েদারবি তাদের শহরের সহিংস অপরাধ কম হওয়ার সম্পর্কে বলেন, “কেনেশ’তে বন্দুকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই সহিংসতা কম থাকার কারণ, বন্দুক নয়।”
তিনি বলেন, “এটা বন্দুক নাকি চামচ, মুষ্টি বা উঁচু জুতো সে বিষয় নয়। বিষয় হলো আমরা নিজেদের এবং প্রতিবেশিদের রক্ষা করি।”
অস্ত্র আইনটি পাস হওয়ার দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে কেনেশ’ সিটি কাউন্সিলে যোগ দেন প্যাট ফেরিস।
তিনি বলেন, আইনটি এখন সবকিছুর ঊর্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে গেছে।
ইলিনয় রাজ্যের মর্টন গ্রোভ প্রথম শহর যেকানে আইন করে বন্দুক নিষিদ্ধ করার পর কেনেশ’ আইন করে অস্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক করলে দেশজুড়ে খবরে পরিণত হয়।
১৯৮২ সালে আইনটি পাস হওয়ার পরে নিউ ইয়র্ক টাইমস এক মতামতে বলা হয় আইনটি পাস করে কেনেশ’ এর কর্মকর্তারা ‘আনন্দিত হলেও ‘ইয়াঙ্কি অপরাধতত্ত্ববিদরা’ নয়।
এমন কি পেন্টহাউজ ম্যাগাজিন ঘটনাটি তাদের কভার স্টোরি করে। এর পর টেক্সাস, ভার্জিন ও উটাহসহ অন্তত পাঁচটি শহরের এইক ধরনের অস্ত্র আইন পাস হয়।
পাস হওয়ার প্রায় ৪০ বছর পর আইনটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফেরিস বলেন,এ আইনের অস্তিত্ব ফিকে হয়ে গেছে। আমি জানি না এমন একটা আইন আছে সেটা কতজন জানেন।
যে বছর অস্ত্র আইনটি পাস হয় ওই একই বছর জন্ম নেন চার্চের গ্রাউন্ডসকিপার ওয়েদারবাই।
তিনি বলেন তার বাবা মজা করে বলতেন, তুমি বন্দুক পছন্দ করো আর না করো, এটাই আইন।
“আমাকে এটাই শেখানো হয়েছে যে তুমি পুরুষ হলে তোমার বন্দুক থাকতেই হবে।”
১২ বছর বয়সে প্রথম বন্দুকের মালিক হন বলে জানান ৪২ বছর বয়সী ওয়েদারবাই। এক সময়ে তার কাছে ২০টা বন্দুক থাকলেও এখন একটাও নেই বলে জানান তিনি।
২০০৫ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর তার বাবার রেখে যাওয়া বন্দুকসহ সব বন্দুক তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন জানিয়ে বলেন,“ আমার বন্দুক নয় গ্যাস দরকার।”
কেনেশ’ মেইন স্ট্রিটের ডিয়ারক্রিক গান শপে নিজের বন্দুকগুলো বিক্রির জন্য যেতেন বলে জানান ওয়েয়েদারবাই।
দোকানের কর্মী জেমস রাবুন জানান, তিনি স্নাতক পাস করার পর থেকেই এখানে কাজ করছেন। এটা তাদের পারিবারিক ব্যবসা। তার বাবা ও দাদা শুরু করেন। তাদের দুজনেই দোকানে রয়েছেন।
ব্যবসার খাতিরেই কেনেশ’ এর অস্ত্র আইনের অনুরাগী রাবুন। এটা তার ব্যবসার জন্য ভাল।
আগ্রহ নিয়ে তিনি বলেন, বন্দুকের সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এটা মানুষ আত্মরক্ষার জন্য কেনে। তবে এর মধ্যে অনেকে এটাকে শিল্পকর্ম বা বিটকয়েনের মতো অপ্রতুল জিনিসের মতো পছন্দ করে।
তাদের দোকানে বিক্রির জন্য শয়ে শয়ে বন্দুক ঝোলানো রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ডাবল ব্যারেল শটগান, একিন, মাসকেট। এমনকি ১৮ শতকের উইনচেস্টার রাইফেল যা এখন আর বানানো হয় না।
তবে কেনেশ’ তে বন্দুক দোকান মালিক এবং মধ্যবয়সীদের মধ্যে বন্দুকের প্রতি অনুরাগ রয়েছে।
তেমন একজন ক্রিস ওয়েলশ। দুটি কিশোর বয়সী মেয়ে রয়েছে তার। নিজের বন্দুক নিয়ে তিনি বেশ গর্বিত।
তিনি স্থানীয় একটি গান ক্লাবের সদস্য। তার পিস্তল, বেরেটা, গ্লোক ছাড়াও অর্ধ ডজন শটগান রয়েছে বলে জানান তিনি।
কেনেশ’ এর বন্দুক আইন নিয়ে লোকে যখন কথা বলে তখন তিনি বিব্রতবোধ করেন বলে জানান তিনি।
অবশ্য ওয়েলশ কেনেশ’ এর বন্দুক আইনের ভক্ত নন।
তিনি বললেন, “যখন লোকেরা বন্দুক আইন নিয়ে কথা বলে, তখন আমি লজ্জিত বোধ করি। এটি শুধু একটি পুরানো বিষয় যা ধরে রাখা হয়েছে।
“বাইরের লোকেরা যখন এই শহরের কথা ভাববে, তখন তারা পার্ক, স্কুল এবং সম্প্রদায়ের মূল্যবোধের কথা মনে করবে,বন্দুক আইন নয়; “
সিটি কাউন্সিলের সদস্য মাদেলিন ওরোচেনা একমত যে শহরের বাসিন্দারা আইনটির প্রচার পছন্দ করে না।
“এটি আমাদের সমাজ সম্পর্কে ছোট একটি অদ্ভুত তথ্য। এটা শুনে শহরের বাসিন্দারা হয় লজ্জায় চোখ নত করবে অথবা হেসে ফেলবে,” যোগ করেন তিনি।
বিবিসি অবলম্বনে মাহবুবা ডিনা