ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারে আন্দোলনের অন্যতম মুখ হিসেবে শপথ নেন আসিফ মাহমুদ সজিব ভূইয়া। তখনও ছাত্রত্বের গন্ধ গা থেকে যায়নি। বেশভূষা আর শারীরিক গঠনেও বাংলাদেশের আর দশটা বেকার যুবকের ছাপ।
দপ্তর হিসেবে তাকে দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। প্রথমে অবশ্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে তার ইচ্ছায় নতুন দপ্তর বণ্টন করেন মুহাম্মদ ইউনূস।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারে জায়গা পেয়ে যান তখন আসিফ মাহমুদের বয়স পঁচিশের ঘরে। অনেকেই সেসময় এতো অল্প বয়সে অনভিজ্ঞ কাউকে উপদেষ্টা করা মানানসই হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থাকা একজন তরুণ তুর্কির উপদেষ্টা বনে যাওয়া নিয়ে আলোচনা তারুণ্যের জাগরণের সামনে ধোপে টেকেনি।
অনেককেই তখন বলতে শোনা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া কথিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশকে’ এমন তারুণ্যই দিতে পারে সত্যিকারের দিশা। অবশ্য রাত না পোহাতেই উপদেষ্টা হিসেবে বিদেশি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অশুদ্ধ ইংরেজি আর বাংলার মিশেলে কথোপকথনের পর সে আশা খানিকটা ফিকে হয়ে এসেছিল। সামাজিক মাধ্যমে রীতিমতো ট্রলের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিষয়ে অধ্যয়ন করেও ন্যূনতম ইংরেজি না জানার বিষয়টি সামনে এলে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে যায়।
তবে যেটাই হোক, গেল বছরের ৮ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপদেষ্টা হিসেবে ‘দায়িত্ব’ পালন করে গেছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। মাত্র ১৬ মাসে ওঠেছে দুর্নীতি, প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতির মতো অসংখ্য অভিযোগ। সেই সঙ্গে মলিন চেহারার যুবকের বেশভূষা ছুড়ে ফেলে হয়েছেন অভিজাত; রাতারাতি পাঁচ তারকা হোটেলকে করে নিয়েছেন আড্ডার জায়গা।
এতসব বদলের ভিড়ে দেশের কথা কী তবে ভুলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া আসিফ মাহমুদরা?
এর উত্তর মেলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের কাছে।
বাংলাদেশের একটি দৈনিককে তিনি বলেছেন, ছাত্র প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টার কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। সেই প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভূমিকা তারা রাখতে পেরেছেন, তা বলা যাবে না; বরং তাদের মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং তাদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
তো কী রয়েছে আসিফম মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ষোল মাসের আমলনামায়? শোনা যাচ্ছে, তার রেখে যাওয়া ‘স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের’ দ্বায়িত্ব নিতে অপরাগতা জানিয়েছেন বর্তমান উপদেষ্টারা। কারণ হয়তো, তার বিছিয়ে যাওয়া দুর্নীতির অভিযোগে নিজেদের জড়াতে চাইছেন না তারা।
বুধবার আসিফ মাহমুদের পদত্যাগপত্র পাওয়ার পর দপ্তরের নতুন দ্বায়িত্ব বণ্টন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ কয়েকজন উপদেষ্টাকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে কথাও বলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলসহ অন্তত ৫ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতি আর অনিয়মের কেন্দ্রে বারবার উঠে এসেছে ‘ছাত্র প্রতিনিধি’ হিসেবে উপদেষ্টা হওয়া সরকার পতনের এই ‘সমন্বয়ক’। পদ বাণিজ্য, প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়, স্বজনপ্রীতিসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এজন্য প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, এরপর অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন, সড়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকে বললেও তারা কেউ রাজি হননি।
শেষমেশ শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বে থাকা আদিলুর রহমানকে ‘একপ্রকার জোর করেই’ আসিফ মাহমুদের দপ্তর ‘গছিয়ে’ দেওয়া হয়েছে।
দুই বিদায়ী উপদেষ্টাকে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতেই পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। তবে তারা সেসময় পদত্যাগ না করে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণে নিমজ্জিত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। “এটি ভালো দৃষ্টান্ত হয়নি,“ বলেছেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।
ষোল মাসের আমলনামা
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই উপদেষ্টার উত্তরবঙ্গ সফর ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া মাত্র ছয় দিনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে ২৮ বার হেলিকপ্টারে চড়েছেন। ওই ঘটনা নিয়ে খোদ অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা শুনতে হয়।

এরপর ২০২৫ সালের এপ্রিলে তার বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়ে পড়েন ফের বিতর্কের মুখে। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে চলে যায় যে, নিজের বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিল করে সেটি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে ক্ষমা চাইতে হয় তাকে।
এর আগে আসিফের বন্ধু ও এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। কয়েকশ কোটি টাকার দুর্নীতির মুখে এপিএসকে সরিয়ে দেওয়া হয় দায়িত্ব থেকে।
চলতি বছরের ২৯ জুন ফের আলোচনার জন্ম দেন আসিফ মাহমুদ। ওআইসি ইয়্যুথ ক্যাপিটাল গ্রোপ্রামে অংশ নিতে মরক্কো যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে তার ব্যাগে গুলিভর্তি ম্যাগাজিন পাওয়া যায়। যদিও তিনি সেসময় দাবি করেছিলেন, তার বৈধ লাইসেন্স রয়েছে।
ঘটনাটি প্রকাশের পর তা নিয়ে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়। আসিফ মাহমুদ অস্ত্র কোথায় পেলেন? এটি একে-৪৭ রাইফেল, এমন কথাও ছড়িয়ে পড়ে। আবার এনিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তা সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আসে।
ওই ঘটনার পর আসিফ মাহমুদ তার ব্যক্তিগত ফেইসবুক একাউন্টে এক স্ট্যাটাসে ঘটনার ব্যাখ্যা দেন, তাতে তিনি বলেন, ভুল করে ওই ম্যাগাজিনটি তার হাতব্যাগে রয়ে গিয়েছিল।
এর বাইরে গুলশানে ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপির বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায়ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠেছিল।
চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন তারই ঘনিষ্ট বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপু। পরে ওই ঘটনায় যে উপদেষ্টা আসিফের হাত রয়েছে তা অপুর বয়ানে প্রকাশ পায়। প্রকাশ পায় ঘটনার ভিডিও।
স্কুল শিক্ষক বাবা বিল্লাল হোসাইনের নানা কর্মকাণ্ডে নিজের প্রভাব খাটানোর কারণেও পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু শিক্ষিকা নির্যাতনসহ একাধিক অভিযোগ।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক শিখা রানীকে পদত্যাগে বাধ্য করতে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের অভিযোগে বাবার সঙ্গে উপদেষ্টার নাম সামনে আসে।
শিখা রানী অভিযোগ করেছিলেন, স্কুলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আসিফের বাবা বিল্লাল হোসেনকে ২০১৪ সালে বহিষ্কার করার প্রতিশোধ নিতে এ কাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
দেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্রিকেট বোর্ড গঠনে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে সরাসরি নিয়মবহির্ভূত হস্তক্ষেপেরও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের মতো করে জেলা ও বিভাগের কাউন্সিলর নিয়োগ করে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক নিয়োগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
উপদেষ্টার ফিরিস্তি
বুধবার পদত্যাগের আগে আসিফ মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীন উন্নয়ন ও অর্জনের লম্বা ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
তিনি জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৩টি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ৩২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া অনুমোদনের অপেক্ষায় ২১টি প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর প্রাক্কলিত ব্যয় ১২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা।
২০২৪–২৫ অর্থবছরে এলজিইডির অর্জন হিসেবে উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা জানিয়েছেন তিনি।
ডিপিএইচইয়ের অর্জন হিসেবে বিভিন্ন পানির উৎস, ড্রেন নির্মাণ, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক স্থাপনা উন্নয়নের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। ব্যয় সাশ্রয় হিসেবে ৩১টি প্রকল্প থেকে ২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা সাশ্রয়ের কথা বলেছেন। এ ছাড়া ই–রিকশার পাইলটিং কর্মসূচি, গাইবান্ধায় তিস্তা নদীর ওপর সেতু উদ্বোধন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিলের কথাও বলেন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম ও সাফল্যের কথাও তুলে ধরেন আসিফ।
কিন্তু আসিফ মাহমুদের লিখিত ফিরিস্তির মধ্যে দুর্নীতি-অনিয়ম দমনে কী কী করেছেন, তা পাওয়া যায়নি। হদিশ মেলেনি সচ্ছতা নিশ্চিতে, অপচয় দূর করতে, প্রকল্পের গুণগত মান ও কাজের মান বৃদ্ধিতে তিনি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সে বিষয়ে।
আসিফ মাহমুদের সময় বেশ কিছু বিতর্কিত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তার সময়ে জেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪৪ উপজেলায় পাঠাগার করার প্রকল্প নেওয়া হয়। যদিও পাঠাগার করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। তারা কিছু জানতই না। ঢাকার ফুসফুস নামে পরিচিত ওসমানী উদ্যানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, যা নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তি আছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৪৬ কোটি টাকা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ যেভাবে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ অপচয় করত, আসিফ ভুঁইয়ার সময়ে তেমন দুটি প্রকল্প নিয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। ব্যয় ৩৪৬ কোটি টাকা।



