ইংরেজি ‘ক্লিন‘ শব্দের আভিধানিক বাংলা হলো ‘পরিষ্কার’; সাফও বলা যায়। শব্দটি কোন বাক্যে ব্যবহৃত হলো তার উপর নির্ভর করে এর উদ্দেশ্য।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা প্রশ্নে ‘ক্লিন‘ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন বেশ ক’বার। এখন প্রশ্ন হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজাকে এই ‘পরিষ্কার’ করা বলতে কি ওই অঞ্চলের ধ্বংসস্তূপ সাফ কথা বুঝিয়েছেন, না কি সেখানকার গোটা জনগোষ্ঠীকেই ‘পরিষ্কার’ অর্থে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন?
এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য শপথ নেওয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, তিনি চান জর্ডান ও মিশর যেন আরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে গ্রহণ করুক। এটি তার গাজা `ক্লিন আউট‘ করার একটি পরিকল্পনার অংশ।
গাজাকে সাফ বা পরিস্কার করার এমন বিতর্কিত প্রস্তাব আগে শোনা যেত ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর কট্টরপন্থী সদস্যদের মুখে।
শনিবার এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ট্রাম্প জানান, তিনি জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহ দ্বিতীয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জর্ডান আগেই কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু নতুন করে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব এর আগেই আবদুল্লাহ ও অন্যান্য আরব নেতারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ট্রাম্প বলেন, “আমি তাকে বলেছি, আমি চাই আপনি আরও শরণার্থী গ্রহণ করুন। কারণ আমি এখন গাজার পুরো অঞ্চল দেখছি, এটি একটি বিশৃঙ্খলা। আমি চাই তিনি লোকজন নিক। আমি চাই মিশরও লোকজন নিক।
“আপনারা সম্ভবত দেড় মিলিয়ন মানুষের কথা বলছেন। আমরা পুরো জায়গাটি সাফ করে ফেলব।“
গাজাবাসীদের স্থানান্তর প্রশ্নে ট্রাম্প আরও বলেন, “আমি কিছু আরব দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। অন্য এক জায়গায় বাসস্থান তৈরি করতে চাই, যেখানে তারা হয়তো শান্তিতে থাকতে পারবে।“
এমন ব্যবস্থা কতদিনের জন্য, ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এই সমাধানটি অস্থায়ী হতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে।“
ট্রাম্পের এমন মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এনিয়ে গত রোববার হোয়াইট হাউসের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে কিছু বলা হয়নি। এমনকি জর্ডানের রাজপ্রাসাদ ও হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল বিবৃতিতেও ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও সদ্য বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির বিরোধিতা করেছে। ইসরায়েলের আরব প্রতিবেশী দেশগুলোও এর বিরোধিতা করে বলেছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বের করে দিয়ে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে দুর্বল করতে চায় বলে তাদের আশঙ্কা।
হামাস ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা করে ১,২০০ জনকে হত্যা ও ২৫০ জনকে জিম্মি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় পাল্টা হামলা চালায়। এতে গাজা উপত্যকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ তাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় এবং সেখানকার অধিকাংশ অংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
সমালোচকদের অভিযোগ, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে বরং জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের কয়েকজন চরমপন্থী নেতা মনে করেন, গাজার মানুষকে অন্য দেশে চলে যেতে বলা উচিত। দেশটির অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ ২০২৩ সালে বলেন, গাজার মানুষ যদি স্বেচ্ছায় অন্য দেশে যায়, তাহলে এটি তাদের ও পুরো অঞ্চলের জন্য ভালো সমাধান হতে পারে। আরেকজন কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক ইতামার বেন গিভির বলেন, ফিলিস্তিনিদের উৎসাহিত করা উচিত যাতে তারা স্বেচ্ছায় অন্য দেশে চলে যায়।
২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই কিছু ইসরায়েলি পরিকল্পনাকারী গাজার মানুষকে মিশরের সিনাই উপদ্বীপে স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরা একটি আলাদা রাষ্ট্র পেতে পারে। এই বিষয়ে অনেক বছর ধরে ফিলিস্তিনি, ইসরায়েলি এবং আরব নেতারা আলোচনা করেছেন।
তবে এটি খুবই বিতর্কিত, কারণ ফিলিস্তিনিদের বারবার জোরপূর্বক স্থানান্তরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সময় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনাকে আরবিতে ‘নাকবা‘ বা ‘বিপর্যয়‘ বলা হয়। এরপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরও বহু মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারান।
ট্রাম্পের মন্তব্যের পরে হামাস ও আরব সরকারগুলো দ্রুত এর সমালোচনা করেছে। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের পরিকল্পনার পক্ষে কাজ করছে। তারা মিশর, জর্ডান এবং অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে বলেছে, তারা যেন ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রবিবার এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের ‘অটুট সমর্থন‘ পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে তাদের ভূমির অধিকারের কথা উল্লেখ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এই অধিকারের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ, যেমন স্থানান্তর ও বসতি সম্প্রসারণ, কঠোরভাবে নিন্দনীয়।
ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থানরত মিশরের রাষ্ট্রদূত মোতাজ জাহরান ২০২৩ সালের অক্টোবরে হিল পত্রিকায় প্রকাশিত এক কলামে এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “মিশরের অবস্থান স্পষ্ট: ফিলিস্তিনিদের সিনাইয়ে স্থানান্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো সমাধানের অংশ হওয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের পদক্ষেপ একটি দ্বিতীয় নাকবার জন্ম দেবে। যারা তাদের পৈতৃক ভূমির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখে আসছে, এটি তাদের জন্য অকল্পনীয় বিপর্যয়কর হবে।“
জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদিও ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের বিষয়ে আমাদের অবস্থান দৃঢ় এবং তা অপরিবর্তনীয়। জর্ডান জর্ডানীয়দের জন্য এবং ফিলিস্তিন ফিলিস্তিনিদের জন্য।“
যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহ পর ইসরায়েলের সাবেক কর্মকর্তারা এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মিত্ররা প্রকাশ্যে প্রস্তাব দেন গাজার বাসিন্দাদের সাময়িকভাবে মিশরের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তর সিনাই উপদ্বীপের তাবুর শহরে স্থানান্তর করা হোক। প্রস্তাবকারীদের মধ্যে ইসরায়েলের সাবেক ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যানি আয়ালনও ছিলেন।
এই প্রস্তাবকে গাজা উপত্যকায় জাতিগত নির্মূলের সঙ্গে তুলনা করে সমালোচনা করা হয়। হামাসের আক্রমণের কিছুদিন পর ইসরায়েলের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের ফাঁস হওয়া একটি পরিকল্পনা নথি প্রকাশ করে দেশটির ওয়েবসাইট লোকাল কল। গাজার বেসামরিকদের সিনাইতে সরানোর বিকল্প প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন ছিল ওই পরিকল্পনায়।
ইসরায়েলের একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা আমির আবিভি। তিনি গাজার মানুষদের সিনাইয়ে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন, এই পরিকল্পনা ২০২৩ সালের যুদ্ধ শুরুর আগেই আরব নেতারা চিন্তা করছিলেন।
পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকে মিশরের নেতাদের একটি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, যাতে গাজার সীমান্তের কাছে উত্তর সিনাইয়ে ফিলিস্তিনিদের বসবাস ও একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল।
আমির আবিভি বলেন, “আমরা এই ধারণাটি কয়েক বছর আগে উত্থাপন করেছিলাম। আর এখন মনে হচ্ছে, এটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গাজা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে একটি কট্টর সন্ত্রাসী সংগঠন শাসন করছে। সেখানকার অনেকেই গাজা ছাড়তে চায়। তাই মিশরকে সীমান্ত খোলার আহ্বান জানানো হলো সবচেয়ে মৌলিক মানবিক কাজ।“
একসময় ফিলিস্তিনি আলোচক দলের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ফিলিস্তিনি কানাডীয় আইনজীবী ডায়ানা বুট্টু। তিনি জানান, মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাতাহ আল-সিসি ইসরায়েলের যা চাওয়া তা দিতে চাইবেন না। তারা ফিলিস্তিন ভূমি চায়, তবে সেখানে ফিলিস্তিনিদের দেখতে চায় না।
বুট্টু বলেন, “এতে নতুন কিছু নেই। গাজাকে মুছে ফেলে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করা মানে ফিলিস্তিনিদের একে অপরের স্থানে প্রতিস্থাপন করা এবং ইসরায়েল যে ক্ষতি করেছে তা মুছে ফেলার চেষ্টা করা।”
চ্যাথাম হাউস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মিডল ইস্ট ও নর্থ আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক সানাম ভাকিল মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের সাম্প্রতিক বাস্তুচ্যুতির কারণে এই ধারণাটি এখন অনেক বেশি সংবেদনশীল।
ইসরায়েলের সঙ্গে ২০শ শতকের সংঘাতে অনেক ফিলিস্তিনি নিকটবর্তী আরব দেশগুলোতে পালিয়ে গিয়েছিল। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়ায় আনুমানিক ৪ লাখ ৩৮ হাজার, লেবাননে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ও জর্ডানে প্রায় ২৪ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন।
২০২৩ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ওয়াশিংটন পোস্টকে পরের বছরের জুনে জানিয়েছিল, গত অক্টোবর থেকে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার গাজাবাসী মিশরে প্রবেশ করেছে এবং অনিশ্চিত অবস্থায় বসবাস করছে। তাদের কোনও আইনগত মর্যাদা নেই ও যাওয়ার আর কোনো জায়গাও নেই।
তথ্যসূত্র : আরব নিউজ, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউ ইয়র্ক টাইমস।