যুক্তরাষ্ট্রকে বলাই হয় অভিবাসীদের দেশ; ইউরোপসহ সারাবিশ্বে থেকে মানুষ গিয়ে থিতু হয়ে গড়ে তুলেছে দেশটি। সেই দেশটি এখন অভিবাসীদের জন্য কঠিন করে তুলতে চান নতুন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, যার স্ত্রীও একজন অভিবাসী।
সোমবার প্রেসিডেন্ট হিসাবে দ্বিতীয়বার শপথ নেওয়ার পর অভিষেক ভাষণেই ট্রাম্প বলেছেন, লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠাবেন তিনি। মেক্সিকো সীমান্তে জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করেন তিনি।
এরপর প্রেসিডেন্ট হিসাবে শতাধিক নির্বাহী আদেশে তিনি সই করেন, যার একটিতে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভের বর্তমান অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের অধিকার দেশটির সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুরক্ষিত। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কেউ অবৈধভাবে বসবাস করলেও তার সন্তান সেই মাটিতে হলে সে দেশটির নাগরিকত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে পায়।
ট্রাম্প তাতে বাদ সেধেছেন। তিনি বলেছেন, যদি কোনও ব্যক্তির মা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে থাকেন এবং বাবা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা না হন, তাহলে সেই ব্যক্তি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাবেন না।
নতুন আদেশ ৩০ দিনের মধ্যে কার্যকরের ঘোষণা ট্রাম্প দিয়ে রেখেছেন। তবে তিনি কীভাবে এটি কার্যকর করবেন, তাতে এখনও অস্পষ্টতা দেখার কথা জানিয়েছে বিবিসি।
আবার ট্রাম্প সই করার পরপরই দ্য আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন এবং অন্য গ্রুপগুলো এই নির্বাহী আদেশ চ্যালেঞ্জ করে মামলা ঠুকেছে।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব কীভাবে পায়?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর প্রথম বাক্যেই জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নীতির বিষয়টি বলা হয়েছে। সেখানে বলা আছে, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া বা নাগরিক অধিকার পাওয়া সব ব্যক্তিই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, রাষ্ট্রের যেখানেই তারা বাস করুন না কেন।
অভিবাসনবিরোদী কট্টরপন্থীরা অনেক সময় বলে থাকেন, এই নীতিই অবৈধ অভিবাসনের পথ তৈরি করে দিয়েছে। এটা গর্ভবতী নারীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সন্তান প্রসবের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলেছে।
একে অনেক সময় ‘বার্থ ট্যুরিজম’ বলা হয়ে থাকে। এভাবে জন্ম নেওয়া শিশুকে ডাকা হয় ‘অ্যাংকর বেবি’ নামে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয়েছিল ১৮৬৮ সালে, গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। এর মাধ্যমে আমেরিকায় জন্ম নেওয়া দাসদের নাগরিকত্বের বিষয়টির সুরাহা করা হয়েছিল। এরপর ১৮৯৮ সালে অভিবাসীদের সন্তানদের ক্ষেত্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নীতির প্রয়োগ নিশ্চিত করেছিল দেশটির সর্বোচ্চ আদালত।

এটি বদলে কি দিতে পারবেন ট্রাম্প?
ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে সই করলেও আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার হরণ করা যায় না।
ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক সাইকৃষ্ণ প্রকাশ বিবিসিকে বলেন, “তিনি এমন কিছু করেছেন, যা বহু মানুষকে হতাশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে আসলে সিদ্ধান্ত হবে আদালতে।”
কেন? তার উত্তরে তিনি বলেন, “এটা এমন কোনো বিষয় নয় যে তিনি নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি লম্বা আইনি লড়াইয়ের সূচনা করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে।”
সংবিধানের একটি সংশোধনীর মাধ্যমে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সুবিধা বাতিল করা যায়, কিন্তু তার জন্যও দরকার হবে প্রতিনিধি পরিষদ ও সেনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট। তাহলেই শুধু হবে না, তিন- চতুর্থাংশ রাজ্যকে সেটি অনুমোদন করতে হবে।
কত মানুষের ওপর প্রভাব?
পিউ রিসার্চ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে অবৈধ অভিবাসী বাবা-মায়ের মোট সন্তান জন্ম নিয়েছিল আড়াই লাখ, যা ২০০৭ সালের চেয়ে ৩৬ শতাংশ কম। কিন্তু ২০২২ সালে এমন ১২ লাখ মার্কিন নাগরিকের জন্ম হয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের ঘরে।
এসব সন্তানদের সন্তানও হবে মার্কিন নাগরিক। ২০৫০ সাল নাগাদ অবৈধ অভিবাসীদের সন্তান সংখ্যা ৪৭ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে দ্য মাইগ্রেশন পলিসি ইন্সটিটিউট নামের একটি সংস্থা।
এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ট্রাম্প এর আগে বলেছিলেন, অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের বাবা-মায়ের সঙ্গে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো উচিৎ, এমনকি তাদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে হলেও।
মামলা হলো সঙ্গে সঙ্গেই
এমনিতেই অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের বিরোধিতার মুখে রয়েছেন ট্রাম্প। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলে তার সিদ্ধান্তের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সংগঠনগুলো।
একটি সংগঠন বলেছে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আমেরিকার মূল্যবোধ সমুন্নত রাখবে না। আরেকটি সংগঠন বলেছে, ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসীদের জীবন ধ্বংসের জন্য সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেছে।
সোমবারই নিউ হ্যাম্পশায়ার জেলা আদালতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন নিউ হ্যাম্পশায়ার ইন্দোনেশিয়ান কমিউনিটি সাপোর্ট, লিগ অব ইউনাইটেড ল্যাটিন আমেরিকান সিটিজেনস ও মেইক দ্য রোড নিউ ইয়র্ক।
আসামির তালিকায় ট্রাম্পের সঙ্গে রয়েছেন পররাষ্ট্র দপ্তর ও দপ্তরের মন্ত্রী, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তর ও দপ্তরের মন্ত্রী, কৃষি দপ্তর ও দপ্তরের মন্ত্রী এবং সেন্টারস ফর মেডিকেয়ার অ্যান্ড মেডিকেইড সার্ভিসেস ও সংস্থার প্রশাসক।
মামলায় ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংবিধানে উল্লেখিত নির্দেশ, কংগ্রেসের লক্ষ্য ও সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ ও এর পরিপ্রেক্ষিতে করা মামলা নিয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)।
১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই নাগরিক অধিকার সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি ডি রোমেরো বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “এই দেশে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের নাগরিকত্ব না দেওয়া কেবল অসাংবিধানিকই নয়, একই সঙ্গে এটি আমেরিকান মূল্যবোধের প্রতি একটি বেপরোয়া ও নিষ্ঠুর অস্বীকৃতিও বটে।
“যেসব বিধান যুক্তরাষ্ট্রকে শক্তিশালী ও গতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলেছে, তার মধ্যে একটি এই জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব।”
ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এই আদেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া মানুষদের অধিকার হরণ করে এবং স্থায়ীভাবে তাদের উপশ্রেণিতে পরিণত করে আমেরিকান ইতিহাসে অন্যতম গুরুতর ভুলের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে।”
মামলায় জয়ী হওয়ার আশা রেখে এসিএলইউর নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি ডি রোমেরো বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এই আঘাত আমরা অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করব। ট্রাম্প প্রশাসনের অত্যাধিক ক্ষমতাপ্রয়োগ এতটাই গুরুতর যে, শেষ পর্যন্ত আমরাই বিজয়ী হব, সে বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী।”
মামলার বাদী পক্ষের প্রধান আইনজীবী কোডি উফসি বলেন, “জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা ভয়াবহ নির্মম পদক্ষেপ এবং দেশ হিসেবে আমাদের মূল্যবোধের পরিপন্থী।”